যান, চলে যান।
খায়রুল মিয়া উঠে গেল। হাসান ঘড়ির দিকে তাকাল সাড়ে নটা বাজে। গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত এই মুহূর্তে নিয়ে নিতে হবে। হাতে সময় নেই।
সিদ্ধান্ত এক,
ইলিশ মাছ কেনার জন্যে নিউ মার্কেটে যাওয়া যাবে না। ইলিশ মাছ কিনতে গেলে যথাসময়ে চাকরির ইন্টারভিউতে হাজির হওয়া যাবে না।
সিদ্ধান্ত দুই,
ইলিশ মাছ কাউকে দিয়ে কেনাতে হবে। দায়িত্বটা দিতে হবে খায়রুল মিয়াকে। এই লোকটি নিখুঁতভাবে দায়িত্ব পালন করবে।
সিদ্ধান্ত তিন,
যেহেতু মাছ কিনতে যাওয়া হচ্ছে না, হাতে সময় আছে— এই সময়টা আনন্দে কাটানোর ব্যবস্থা করতে হবে। টেলিফোনে নোরার সঙ্গে কথা বলা যায়। তার একটা বিপদ অবশ্যি আছে। নোরা বলে বসতে পারে— কী করছ, এক্ষুণি চলে আস তো। নোরা বললে অবশ্যই সব ফেলে দিয়ে চলে যেতে হবে। ইন্টারভিউ দেয়া হবে না। তখন মনে হবে কীসের ইন্টারভিউ, কীসের কী?
মুহিব ভুরু কুঁচকে আছে। সে যে গভীর চিন্তায় ড়ুবে আছে এটা তার লক্ষণ। তার বুকে ধুকধুক শব্দ হচ্ছে। ধুকধুক শব্দ নিশ্চয়ই সারাক্ষণ তার বুকে হচ্ছে। কিন্তু সে শুনতে পায় শুধু যখন তার ভুরু কুঁচকে থাকে। ব্যাপারটা কি শুধু তার একার ক্ষেত্রে ঘটে, না সবার ক্ষেত্রে ঘটে? দি আল মদিনা রেস্টুরেন্টের মালিক খায়রুল মিয়ার বুকও কি গভীর চিন্তার সময় ধুকধুক করে?
খায়রুল মিয়া তার পাশে রাখা চিলমচিতে পানের পিক ফেলতে ফেলতে বলল, ডিমওয়ালা ইলিশ কিনবেন কী জন্যে? ডিমওয়ালা ইলিশে স্বাদ হবে না।
মুহিব বলল, স্বাদের দরকার নাই, আমার দরকার ডিম। বড়ভাইজানের খায়েস হয়েছে ইলিশ মাছের ডিম খাবেন।
তাহলে এক কাজ করি, ধূপখোলার বাজারে ইলিশ মাছের ডিম আলাদা বিক্রি হয়। সেখান থেকে ডিম কিনে আনি আর আলাদা একটা ডিমছাড়া ইলিশ কিনি। ডিম আলাদা। মাছ আলাদা।
যা ইচ্ছা করেন, শুধু মনে রাখবেন সকাল সকাল বাজার পৌঁছাতে হবে। লিস্টে যা যা লেখা সব যেন যায়। আরেকটা কথা, আমার সঙ্গে কথা বলার সময় দুবার তিনবার করে কিছু বলবেন না। শুধু শুধু সময় নষ্ট। আমি আপনার ঠোঁট নাড়া দেখেই বুঝতে পারি কী বলছেন।
আপনি যান কই?
আমি কোথায় যাই তা দিয়ে আপনার কোনো দরকার নেই। যা করতে বলছি করেন।
কাঁচা সুপারি দিয়ে একটা পান খাবেন? হার্টের জন্যে ভালো।
পান খাব না। আমার হার্টের ট্রিটমেন্টের প্রয়োজন নেই। হার্ট ভালো আছে। বকরি লাদির ট্রিটমেন্ট চলছে।
খায়রুল মিয়া গলা নামিয়ে বলল, ভাইজান, আজ সন্ধ্যার পর কি কোনো কাজ আছে?
কেন?
আমি যে ফ্ল্যাটটা কিনলাম আপনাকে দেখাতাম। মনে খায়েশ ছিল।
দেখি, যদি সময় করতে পারি।
ফার্নিচার কিনি নাই। আপনাকে সাথে নিয়ে কিনব।
আমাকে সাথে নিয়ে কিনবেন কেন?
কোনটা ভালো কোনটা মন্দ এটা তো আমি বুঝব না। বুঝেন না ভাইজান আমি পথের কাঙাল ছিলাম। পঞ্চাশ টাকা ভাড়ার বস্তির ছাপড়ায় থাকতাম। এখন পয়সা হয়েছে, কিন্তু মনের কাঙাল ভাব দূর হয় নাই।
দেখি, যদি সময় করতে পারি…
খুবই খুশি হবো ভাইজান। রাতে আমার সাথে খানা খাবেন। কী খাবেন। বলেন— খিচুড়ি আর মুরগি ঝালাই করি। মুরগি ঝালফ্রাই মজনু বাবুর্চিকে দিয়ে করাব। একবার খেলে বাকি জীবন আর ভুলতে পারবেন না। বলি মজনু বাবুর্চিকে? বলি ভাইজান, বলি?
মুহিব প্রশ্নের জবাব না দিয়ে রেস্টুরেন্ট থেকে বের হলো। এখানে থাকা মানেই খায়রুল মিয়ার বকবকানি শোনা। সে বকবক করেই যেতে থাকবে। অতি ব্যস্ত মানুষদের বকবক করার স্বভাব থাকে না। এই লোকটার আছে। তার গলা দিয়ে শব্দ বের হয় না। তারপরেও সে কথা বলতেই থাকে। খায়রুল মিয়ার টেলিফোনের দোকান থেকে মুহিব নোরাকে টেলিফোন করল। প্রথমবার রিং হতেই নোরা ধরল। হ্যালো শব্দটা এত সুন্দর করে বলল যেন এটা কোনো ইংরেজি শব্দ না, এটা বাংলা গানের সঞ্চারী। মুহিব বলল, কী খবর নোরা?
নোরা বলল, আপনি কে বলছেন জানতে পারি কি?
বুকে ধাক্কা লাগার মতো বাক্য। এখনো কি নোরা তার গলা আলাদা করে চিনতে পারে না? না-কি সে চিনেও ভান করে চিনতে পারছে না। অবশ্যি এও হতে পারে যে আপনি কে বলছেন জানতে পারি কি বাক্যটি নোরা অভ্যাসবশত বলে। হয়তো খুব ছোটবেলায় তাকে শেখানো হয়েছে— কেউ টেলিফোন করলে প্রথমেই বলবে— আপনি কে বলছেন জানতে পারি কি? যে টেলিফোন করেছে তার পরিচয় জানার পর অন্য কথা বলবে। ছোটবেলার অভ্যাস এখনো রয়ে গেছে।
নোরা, আমি মুহিব।
ও আচ্ছা, তুমি? কী করছ?
কিছু করছি না।
নোরা খিলখিল করে হাসতে হাসতে বলল, আমি কী করছি বলো তো? তুমি কল্পনা করতে পারবে না এমন একটা জিনিস করছি।
সেটা কী?
নোরা হাসি থামিয়ে গম্ভীর গলায় বলল, সিগারেট খাচ্ছি। সকালে চায়ের সঙ্গে প্রথম সিগারেট খেয়েছি। এখন তো প্রায় দশটা বাজছে, এর মধ্যে চারটা সিগারেট খেয়ে ফেলেছি। চতুর্থটা এখনো শেষ হয় নি। হাতে আছে।
মুহিব বিস্মিত গলায় বলল, সিগারেট খাচ্ছ কেন?
খেয়ে দেখছি কেমন লাগে। তেমন কোনো গুড ফিলিং হচ্ছে না, তবে গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেছে। খুব পানির পিপাসা হচ্ছে। এক জগ পানি খেয়ে ফেলেছি, তারপরেও পানির পিপাসা যাচ্ছে না।
মুহিব বলল, সত্যি সিগারেট খাচ্ছ?
নোরা বলল, হ্যাঁ। না খেলে মিথ্যা করে কেন বলব? এই মুহূর্তে আমি কী করছি মন দিয়ে শোন। আমি ডিভানে শুয়ে আছি। আমার হাতে একটা বই। বইটার নাম— Easy Hypnosis. বাবাকে বলে দিয়েছিলাম আমেরিকা থেকে আসার সময় আমার জন্যে মেসমেরিজম আর হিপনোটিজমের বই আনতে। বাবা হিপনোটিজমের দুটা বই এনেছেন। একটা শেষ করে ফেলেছি। দ্বিতীয়টা পড়ছি। আঠারো পৃষ্ঠা পড়া হয়ে গেছে।