মেজো ভাই মোফাজ্জল করিমের স্ত্রী রোকেয়ার সকালটা কাটে অসম্ভব ব্যস্ততায়। রোকেয়ার দায়িত্ব হলো তার দুই মেয়েকে স্কুলে পৌঁছে দেয়া। মেয়ে দুটা যমজ। একজনের নাম ক, আরেকজনের নাম খ। যমজ মেয়ে হবার সংবাদে খুশি হয়ে মোফাজ্জল করিম দুই মেয়ের এই অদ্ভুত নাম রেখেছে। মেয়ে দুটির জন্ম একুশে ফেব্রুয়ারিতে। সেই হিসেবে নাম দুটির হয়তো বা খানিকটা গুরুত্ব আছে। ক এবং খ দুই বোনই স্কুলের যাবার আগে আগে খুব যন্ত্রণা করে। কান্নাকাটি না, হৈচৈ চিৎকার না। ভারী কোনো কিছু আঁকড়ে ধরে বসে থাকে। কার সাধ্য তাদের ছুটিয়ে নিয়ে স্কুলে যায়। ক খ দুই বোনের যন্ত্রণায় বাড়ির সবাই অস্থির। তবে যন্ত্রণার পুরোটাই নীরব যন্ত্রণা। বাড়ির কেউ দুই মেয়েকে কখনো কাঁদতে শুনে নি।
মুহিব বসার ঘরে ঢুকতেই মোফাজ্জল ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে বলল, তোর ভাবিকে একটু সাহায্য করতো। বিচ্ছ দুটাকে রিকশায় তুলে দে। এরা আমার জীবন নষ্ট করে ফেলল। যে-কোনো একদিন দেখবি বাড়িঘর ছেড়ে সুন্দরবনের দিকে হাঁটা দিয়েছি।
মুহিব কিছুক্ষণ অপেক্ষা করল। দুই ভাইকে সুযোগ দিল তার দিকে ভালো করে তাকাবার। চোখ নিয়ে কেউ কিছু বলে কি-না তার জানার শখ। কেউ কিছু বলল না। বড় ভাই খবরের কাগজ নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ছে। মেজোজন চামচ দিয়ে ঠানঠ্যানা পাতলা খিচুড়ি মুখে দিচ্ছে। তার চোখমুখের ভঙ্গি এরকম যেন চামচে করে ইঁদুর মারা বিষ খাচ্ছে।
নটা দশ বাজে।
মুহিব বসে আছে খায়রুল মিয়ার টি-স্টলে। আল মদিনা রেস্টুরেন্ট। পরোটা, বুন্দিয়া এবং ডিমের ওমলেট দিয়ে সকালের নাশতা করেছে। প্রথম কাপ চা খাওয়া হয়ে গেছে, এখন খাচ্ছে দ্বিতীয় কাপ চা। দ্বিতীয় কাপ চা খাবার ইচ্ছা তার ছিল না। খায়রুল মিয়ার জন্যে খেতে হচ্ছে। সে দুকাপ চা হাতে নিয়ে নিজেই এসে সামনে বসেছে। পান খাওয়া কুচকুচে কালো দাঁত বের করে ফ্যাসফ্যাসে গলায় বলল— ভাইজান নেন, ইসপিসাল চা। কাচা পাত্তি।
খায়রুল মিয়া একজন গলাবিহীন মানুষ। তাকে দেখে মনে হয় তার মাথাটা সরাসরি ঘাড়ে বসিয়ে দেয়া হয়েছে। আল্লাহপাক গলার ঝামেলায় যান নি। ছোটবেলায় কী যেন সমস্যা হয়ে ভোকাল কর্ড নষ্ট হয়ে গেছে। তার বেশির ভাগ কথাই অস্পষ্ট। খায়রুল মিয়া এই সমস্যা জানে বলেই প্রায় সব বাক্যই সে দুবার তিনবার করে বলে।
আল মদিনা রেস্টুরেন্টে মুহিব দীর্ঘদিন ধরে চা খাচ্ছে। মানুষটার সঙ্গে মুহিবের ভালো খাতির আছে। খায়রুল নামের মানুষটার পরিশ্রম করার ক্ষমতা এবং ব্যবসাবুদ্ধি দেখে সে মুগ্ধ। ছাপড়া ঘর দিয়ে টি-স্টল শুরু করেছিল। তখন সে নিজেই চা বানাত। আজ সেই টি-স্টল হুলুস্থুল ব্যাপার হয়েছে। বিরাট সাইন। বোর্ড দি আল মদিনা রেস্টুরেন্ট। দুপুরে এই রেস্টুরেন্টে সিট পাওয়া কঠিন ব্যাপার। আল মদিনার মুড়িঘণ্ট এবং গরু ভুনার খ্যাতি ছড়িয়ে পড়েছে। পাশের ঘরটাও খায়রুল মিয়া নিয়ে নিয়েছে। সেখানে বসেছে টেলিফোনের দোকান। টিএন্ডটি এবং মোবাইল লাইন। সস্তায় দেশে-বিদেশে টেলিফোনের সুযোগ। এর সঙ্গে জিরক্স মেশিন আছে, স্টেশনারি জিনিসপত্র, বই-খাতা, পেনসিলও পাওয়া যায়। খায়রুল মিয়ার রেস্টুরেন্ট যেমন চালু এই দোকানটাও সে-রকমই চালু। এখন খায়রুল মিয়ার মাথায় ঢুকেছে শাড়ির দোকান। বেইলী রোডে সে একটা শাড়ির দোকান দিতে চায়।
খায়রুল বলল, ভাইজানের চোখে কী হয়েছে?
মুহিব বলল, জানি না।
পোকায় কামড় দিছে? পোকা-মাকড় কামড় দিছে?
দিতে পারে।
ওষুধপত্র কিছু দিছেন?
উঁহু।
ব্যথা আছে? ব্যথা?
মুহিব জবাব দিল না। চোখ প্রসঙ্গে এত কথা বলতে তার ইচ্ছা করছে না। খায়রুল তার দিকে ঝুঁকে এসে বলল, শাড়ির দোকানটা নিয়ে চিন্তা নিছেন? নিছেন কোনো চিন্তা?
কী চিন্তা নেব?
আপনাকে কী বলেছি— পুরাটা আপনার হাতে দিয়ে দিব। ক্যাপিটেল আমার, ব্যবসা আপনার। মাসের শেষে হিসাব-নিকাশ হবে।
আরে দূর দূর।
দূর দূর কী জন্যে? ব্যবসা কি খারাপ জিনিস? আমাদের নবিজি কি ব্যবসা করেন নাই? করেন নাই ব্যবসা? আমাদের নবিজি।
মুহিব বিরক্ত গলায় বলল, নবিজি শাড়ির দোকান দেন নাই। মেয়েরা আসবে, গায়ের উপর শাড়ি ফেলে দেখাতে হবে শাড়ি গায়ে দিলে কেমন লাগবে। তিনশ শাড়ি নামাবে, কচলায়ে কচলায়ে দেখবে, তারপর না কিনে চলে যাবে পাশের দোকানে। আমি এর মধ্যে নাই।
ভাইজান, এইগুলা তো আপনি করবেন না। কর্মচারী এইগুলা করবে।
আমি কী করব?
আপনি ক্যাশ দেখবেন। ব্যবসা দেখবেন।
আমি ক্যাশবাক্সের সামনে বসে টাকা গুনব? ভুলে যান।
ফট করে না বলা ঠিক না। চিন্তা করেন। চিন্তা করেন। চিন্তা করেন। চিন্তার প্রয়োজন আছে।
এটা নিয়ে চিন্তা করার কিছু নাই।
দোকান শুরু করতে আমার দেরি আছে। আরো দুই তিনমাস লাগবে। আপনি চিন্তা করেন। আপনাকে তো আমি কর্মচারী হতে বলতেছি না— আমি ব্যবসার শেয়ার দিব।
চুপ করেন তো দেখি। ফ্যাসফ্যাস করে অনেক কথা বলে ফেলেছেন। আরো কথা বললে গলা পুরোপুরি অফ হয়ে যাবে। নিঃশব্দে চা খান। আমি এখন কিছু গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নিচ্ছি। কথা বললে আমার ডিসটার্ব হবে। সিদ্ধান্ত নিতে পারব না।
কী সিদ্ধান্ত?
কী সিদ্ধান্ত সেটা আপনার জানার দরকার নাই। আপনার শাড়ির দোকান বিষয়ক সিদ্ধান্ত না। ব্যক্তিগত ব্যাপার।
আমি কি আপনার সামনে থেকে চলে যাব? চলে যাব ভাইজান?