মহসিন বলল, বরফ আসুক।
সাবের বলল, ফায়ার বানাতে বরফ লাগবে এটা কেমন কথা?
সফিক বলল, শুধু কথা। শুধু কথা। আমার কাছে অসহ্য লাগছে। বরং জিনিস আনতে আনতে গান-বাজনা হোক। খায়রুল ভাই, আপনার ফ্ল্যাটবাড়িতে গান-বাজনা করলে অসুবিধা আছে?
খায়রুল রাগী গলায় বলল, কীসের অসুবিধা? আমার নিজের টেকায় কিনা বাড়ি। কারো বাপের টেকায় কিনি নাই।
সাবের বলল, খায়রুল ভাইয়ের অবস্থা দেখেছিস? জিনিস মাত্র তিনটা পেটে পড়েছে, এর মধ্যেই গলা পরিষ্কার হয়ে গেছে। প্রতিটা শব্দ বোঝা যাচ্ছে।
সফিক গান শুরু করল—
আমরা পুতুলওয়ালা, পুতুল বেচে যাই।
কিছুক্ষণের মধ্যেই গানের কথাবার্তায় কিছু রদবদল হলো।
আমরা আগুনওয়ালা, আগুন দিয়ে যাই
কে নিবি ভাই
কার আগুন চাই
আমরা আগুনওয়ালা।
গানের মাঝামাঝি সময়ে মুহিব এসে উপস্থিত হলো। সফিক গান থামিয়ে বিরক্ত গলায় বলল, তোর এতক্ষণে সময় হলো? ছিলি কোথায়?
মুহিব জবাব দিল না।
সফিক বলল, শরীর খারাপ নাকি? শরীর খারাপ লাগলে হারুনের সঙ্গে গিয়ে শুয়ে থাক।
মুহিব বলল, শরীর ঠিক আছে।
সফিক বলল, গায়ের কাপড় তো সব ভিজা। কাপড় বদলাবি না?
মুহিব বলল, না।
সে দেয়ালে হেলান দিয়ে বসে পড়ল।
রাত দুটার দিকে সবার পেটেই কিছুটা ফায়ার ধিকিধিকি পড়ল। জিনিসটা সুস্বাদু। টক মিষ্টি ঝাল। তবে ঝাঁজ আগুনের মতোই। কিছুক্ষণের মধ্যেই পরিস্থিতি পাল্টে গেল। নীরব ঘাতক সাবের বলল, ফায়ার ধিকিধিকি খাওয়া হচ্ছে আগুন ছাড়া এটা কেমন কথা? টিন ভর্তি কেরোসিন তো আছেই। ঘরে আগুন লাগিয়ে দিলে কেমন হয়?
খায়রুল জড়ানো গলায় বলল, না তো ভাইজান করি নাই। দেন লাগায়ে। জ্বলেপুড়ে যাক।
মহসিন বলল, রোম নগরী যখন পুড়ছিল তখন নিরো বাঁশি বাজাচ্ছিল।
সফিক বলল, একটা ফ্ল্যাট বাড়ি পুড়িয়ে কী হবে? পুরো দেশটা পুড়িয়ে দিতে পারলে মন শান্ত হতো।
সাবের বলল, দেশটা তো পুড়িয়ে দেয়া সম্ভব হচ্ছে না। আমাদের সাধ্যে যা আছে তা করি। ফ্ল্যাটটায় আগুন লাগিয়ে পগার পার হয়ে যাই।
ফায়ার ধিকি ধিকির জগ শেষ হলো রাত তিনটায়। তিনটা দশ মিনিটে টিন ভর্তি কেরোসিন ঢেলে আগুন লাগিয়ে তারা শান্ত ভঙ্গিতে নিচে নেমে এলো। চারদিকে হৈচৈ চেঁচামেচি হচ্ছে। শুনতেও ভালো লাগছে। আগুন ভালোমতো ধরে গেছে। তিনতলার ফ্ল্যাট বাড়ির জানালা দিয়ে কালো ধোঁয়া বের হচ্ছে। এই দৃশ্যও সুন্দর।
সাবের বলল, কন্যার বাপে হুক্কা খায়, বুনকা বুনকা ধোয়া যায়।
সাবেরের ছড়া বলা শেষ হবার আগেই মুহিব চেঁচিয়ে বলল, হারুন ভাই কোথায়? হারুন ভাই তো নিচে নামে নাই। সর্বনাশ!
মুহিব ছুটে সিঁড়ি বেয়ে উঠছে। তার পেছনে পেছনে বন্ধুরাও উঠছে।
সব পত্রিকার প্রথম পাতায়
সব পত্রিকার প্রথম পাতায় খবরটা এসেছে। প্রথম আলো-য় এসেছে ছবিসহ দীর্ঘ প্রতিবেদন।
তরুণ প্রতিবাদী যুবকের আত্মাহুতি
নগরীতে শোকের ছায়া
হারুন ঘোষণা দিয়েছিলেন গায়ে আগুন দিয়ে প্রতিবাদ জানাবেন। তার ঘোষণা কেউই তেমন গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করে নি। সেই অভিমানেই কি তিনি ঘোষণার চব্বিশ ঘণ্টা আগেই চলে গেলেন? তাকে বাঁচানোর চেষ্টা করতে গিয়ে তার এক বন্ধু মুহিব গুরুতর অগ্নিদগ্ধ হয়েছেন। তার অবস্থা আশঙ্কাজনক।
প্রবল ঘোরের ভেতর মুহিবের সময় কাটছে
প্রবল ঘোরের ভেতর মুহিবের সময় কাটছে। ব্যথা-বোধহীন জগৎ। কখনো শরীর হালকা হয়ে যাচ্ছে, সামান্য বাতাস এলেই সে উড়ে চলে যাবে। আবার কখনো শরীর ভারি হয়ে যাচ্ছে। মনে হচ্ছে সে ক্রমেই নিচে নামছে। ক্রমেই নিচে নামছে। সে নেমে যাচ্ছে অতল কোনো গহ্বরে।
মুহিব সারাক্ষণ তার মাথায় বৃষ্টির শব্দ শোনে। ঘোরের মধ্যেই সে অস্থির বোধ করে। তার মনে হয় ঝুম বৃষ্টিতে তাকে কোথায় যেন যেতে হবে। কেউ একজন তাকে বলেছিল, ঝুম বৃষ্টিতে আমার কাছে আসবে। সেই একজনের ছবি কখনো তার মাথায় স্পষ্ট হয় না।
নানান ধরনের ছবি তার চোখের সামনে ভাসে। কখনো সে দেখে সে তার বাবার সঙ্গে রিকশা করে যাচ্ছে। মাথার উপর বৃষ্টি পড়ছে। তারা দুজন হাঁ করে বৃষ্টির পানি খাচ্ছে।
কখনো দেখে কমুদ স্যার এসেছেন তার কাছে। স্যারের গায়ে কোনো কাপড় নেই। স্যার দুঃখিত গলায় বললেন, কই বাবা তুমি তো সেন্টটা দিলে না? সেন্ট ছাড়া চলতে পারি না বলে গায়ে আজেবাজে সেন্ট মাখি। ফিনাইলের মতো গন্ধ। তখন মুহিব তীব্র ফিনাইলের গন্ধ পায়, তার সমস্ত শরীর ঝিমঝিম করে
মুহিব বুঝতে পারে এইসব ছবি সে ঘোরের মধ্যে দেখছে। বাস্তবে এমন কিছু ঘটছে না। তার চারপাশের জগতের কোনো ছবি কোনো শব্দই তাকে স্পর্শ করছে না।
সামান্যতম চেতনা যদি তার থাকত তাহলে তার ভালো লাগত। সে দেখত তার জীবন নিতান্তই বৃথা যায় নি। তার বিছানার পাশে দাঁড়িয়ে নোরা মেয়েটা যতটা ব্যাকুল হয়ে কাদছে ততটাই ব্যাকুল হয়ে কাদছে যূথী।
হাসপাতালের বাইরে অনেক লোক। মুহিবের বাবা শামসুদ্দিন সাহেবও তাদের মধ্যে আছেন। তার শরীর খুবই দুর্বল। তিনি মেঝেতে বসে আছেন।
তাঁর পাশেই তাঁর পিঠে হাত দিয়ে বসে আছেন হোমিওপ্যাথ ডাক্তার রহমতউল্লাহ। এক সময় শামসুদ্দিন সাহেব উঠে দাঁড়ালেন। জড়ানো গলায় বললেন, আমার ছেলে যদি আপনাদের কারো সঙ্গে কোনো অন্যায় আচরণ করে থাকে, দোষ করে থাকে তাহলে আপনারা ক্ষমা করবেন। আমি তার বাবা হিসেবে সবার কাছে ক্ষমা চাই। আমার বাবা তার জীবনে কিছুই পায় নাই। সবার ক্ষমাটা যেন পায়।