অনেক অনেক কাল আগে ময়মনসিংহ শহরে সে একবার তার বাবার সঙ্গে রিকশা করে যাচ্ছিল। হঠাৎ ঝুম বৃষ্টি নামল। শামসুদ্দিন সাহেব ছেলের দিকে তাকিয়ে বললেন, হ্যালো হুঁ বাবা, বৃষ্টিতে ভিজবি? মুহিব বলল, হুঁ।
তিনি রিকশার হুড নামিয়ে দিলেন। দুজন বৃষ্টিতে কাক ভেজা হয়ে রিকশায় বসে আছে। লোকজন দেখে মজা পাচ্ছে। শামসুদ্দিন সাহেব ছেলেকে বললেন, হা করে বৃষ্টির পানি খা। ফ্রেস ওয়াটার। বৃষ্টির পানির টেস্টই অন্যরকম। চলন্ত রিকশায় বসে পিতাপুত্র দুজনই হা করে বৃষ্টির পানি খাওয়ার চেষ্টা করছে। আহারে, কী সুন্দর দৃশ্য!
মুহিব রাগী মেয়েটাকে বলেছিল পানির তৃষ্ণা মরে গেছে। কথাটা সত্যি না। তার তৃষ্ণা ভালোই আছে। সে শৈশবের মতো হা করে বৃষ্টির পানি খাবার চেষ্টা করছে।
রিকশাওয়ালা ঘাড় ফিরিয়ে চিন্তিত মুখে দৃশ্যটা দেখল। বিড়বিড় করে বলল, আপনে যাইবেন কই?
মুহিব বলল, কোথায় যাব সেই সিদ্ধান্ত এখনো নিতে পারি নি। প্রথমে প্রেসক্লাবে যেতে পারি আবার অন্য কোথাও যেতে পারি।
আমি ঐ দিকে যামু না। আপনে নামেন।
মুহিব শান্ত গলায় বলল, না গেলে যেও না। আমি কিন্তু রিকশা থেকে নামব না। তোমার রিকশাটা আমার পছন্দ হয়েছে।
রিকশাওয়ালা ভীত গলায় বলল, স্যার আমি গরিব মানুষ।
মুহিব বলল, আমিও গরিব মানুষ। গরিবে গরিবে কাটাকাটি। ঝামেলা না করে রিকশা চালাও। আমার কাছে শেষ পঞ্চাশটা টাকা আছে। পঞ্চাশ টাকায় যতটুক যাওয়া যায় যাবে। তবে শেষ দফায় এইখানে নিয়ে আসবে। যাত্রা যেখান থেকে শুরু সেখানেই শেষ।
বৃষ্টির বেগ বাড়ছে। মুহিবের ভিজতে ভালো লাগছে।
সফিকদের পুরো দলটা এখন আছে খায়রুলের ফ্ল্যাট বাড়িতে। বৃষ্টি মাথায় নিয়ে প্রেসক্লাবের সামনে বসে থাকার কোনো মানে হয় না। তাছাড়া হারুন অসুস্থ। তার জ্বর এসে গেছে, চোখ লাল। কথাবার্তাও কেমন অসুস্থ। সে চাদর গায়ে দিয়ে কুণ্ডুলি পাকিয়ে শুয়ে আছে। দলের সবাই প্রথমে এই ঘরেই ছিল। সিগারেটের গন্ধে হারুনের বমি আসছে বলে তারা অন্য ঘরে।
সফিক বলল, আমরা আর প্রেসক্লাবের সামনে ফিরে যাচ্ছি না। আত্মাহুতির কথা সবাই ভুলে যাও। যা করা হয়েছে যথেষ্ট করা হয়েছে। খামাখা গায়ে আগুন
মহসিন বলল, আমাদের পাবলিসিটি যা হয়েছে রাস্তায় আর নামা যাবে না। পাবলিক আমাদের দেখলেই ফটকাবাজ বলে গায়ে পেট্রোল ঢেলে দেবে।
সাবের বলল, পাবলিক আমাদের পাবে কোথায়? আমরা হাইবারনেশনে চলে যাব। খায়রুল ভাইয়ের একটা ভালো জায়গা পাওয়া গেছে। এইখানেই থাকব। এইখানেই ঘুমাব।
খায়রুল বলল, কোনো অসুবিধা নাই। যত দিন ইচ্ছা থাকেন।
মহসিন তার বিশেষ হাবিজাবি তৈরি করেছে। হাবিজাবির নাম খবর আছে। নরমালটা না, এক্সট্রা পাওয়ার। দুগ্লাস খেলেই খবর হয়ে যাবে বলেই নাম খবর আছে। কয়েকদফা শরবত খাওয়া হয়ে গেছে। এইসব হাবিজাবি খায়রুলের খাওয়ার অভ্যাস ছিল না। দলের সঙ্গে পড়ে পরপর তিন গ্লাস খেয়েছে। তার কাছে মনে হচ্ছে এই জীবনে এত আনন্দ সে পায় নি। শিক্ষিত বিএ এমএ পাস ছেলেরা তার মতো মানুষের বাড়িতে সহজ-স্বাভাবিক ভঙ্গিতে বসে আছে। দেখতেই ভালো লাগছে। খায়রুল বলল, খাওয়া-দাওয়ার ব্যবস্থা কি করব?
সফিক বলল, খাওয়ার ব্যবস্থার দরকার নেই। আজ সারারাত শুধু দাওয়া।
খায়রুল বলল, দাওয়া কী?
মহসিন বলল, যে জিনিস খাচ্ছেন তার নাম দাওয়া। আপনি তিনটা খেয়েছেন। চার নম্বর পেটে পড়লে বুঝবেন দাওয়া কাকে বলে।
খায়রুল বলল, এইসব খেয়ে মরে যাব না তো ভাইজান?
মহসিন বলল, মরে গেলে মরে যাবেন। বেঁচে থেকে লাভ কী?
খায়রুল বলল, কোনো লাভ নাই।
তৌফিক বলল, আপনি যে মাথার ঘাম পেয়ে ফেলে এত কষ্ট করে টাকাপয়সা করেছেন, লাভটা কী হয়েছে? মনের কষ্ট কি দূর হয়েছে?
জি-না, দূর হয় নাই।
তাহলে এসব রেখে লাভ কী? খবর আছে শরবত আরো দুই গ্লাস খান তারপর আসেন সবাই মিলে আপনার ফ্ল্যাট বাড়িতে আগুন দিয়ে দেই।
খায়রুল গ্লাসে লম্বা চুমুক দিয়ে বলল, আপনারা যা ভালো মনে করেন।
সাবের বলল, কোথাও না কোথাও আগুন দেয়া আমাদের জন্যে ফরজ হয়ে গেছে। গায়ে আগুন দিতে না পেরে হারুন বেচারা মানসিকভাবে বিপর্যস্ত। বড় কোনো আগুন দেখলে যদি তার মনটা ভালো হয়।
‘খবর আছে’ শরবত শেষ পর্যায়ে চলে এসেছে। মহসিন অতি ব্যস্ত হয়ে দ্বিতীয় দফা বানাচ্ছে। একজনকে পাঠানো হয়েছে বরফ আনতে।
মহসিন বলল, এইবার যে জিনিস বানাব তার নাম আগুন ধিকি ধিকি। চুমুকে চুমুকে শরীরে আগুন জ্বলবে।
ইয়াকুব বলল, আগুন ধিকি ধিকি নামটা ভালো লাগছে না। আগুন শব্দটা কেমন ম্যাড়া ম্যাড়া। পাওয়ার নেই। বরং অগ্নি ধিকিধিকি ভালো নাম। অগ্নি যুক্তাক্ষরের শব্দ। ফোর্সফুল হয়।
নীরব ঘাতক সাবের বলল, অগ্নি ফগ্নি কিছুই চলবে না। ইংরেজি-বাংলা মিশিয়ে নাম দিতে হবে। যেমন— Fire ধিকিধিকি।
মহসিন বলল, ফায়ার ছাড়া আগুনের আর কোনো ইংরেজি প্রতিশব্দ আছে?
ইয়াকুব বলল, নেই। ইংরেজি তো আর বাংলার মতো না। ওরা একটা শব্দ নিয়েই খুশি আর আমাদের আছে— আগুন, অগ্নি, অনল, বহি।
সফিক বলল, তোরা কী প্যাচাল শুরু করলি? নাম কোনটা সিলেক্ট হয়েছে? আগুন ধিকি ধিকি না-কি ফায়ার ধিকিধিকি?
মহসিন বলল, আমার কাছে কেন জানি ফায়ার ধিকিধিকিটা বেশি ভালো লাগছে।
সফিক বলল, তুই হচ্ছিস মূল কারিগর। তোর যদি ফায়ার ধিকিধিকি নাম ভালো লাগে তাহলে এই নামই থাকবে। এখন তাড়াতাড়ি জিনিস তৈরি কর।