কেন?
কারণ, বাবা শুধু আপনার কথা বলেন। আপনার ব্যাপারটা তার মাথায় ঢুকে গেছে। তার কথা শুনে মনে হয় এই পৃথিবীতে আপনি ছাড়া তার কোনো প্রিয়জন নেই।
আমি কিছু বুঝতে পারছি না।
বাবার সঙ্গে কথা না বললে বুঝবেন না। ঐ রাতে প্রথম যখন আপনি আমাদের বাসায় ঢুকলেন, বাবা আপনাকে দেখে কী কারণে জানি খুবই খুশি হয়েছিলেন। আপনাকে তার অত্যন্ত আপনজন মনে হয়েছিল। ঐ অংশটাই বাবার মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে। আর সব ধুয়ে মুছে গেছে।
উনি কোথায়?
বাবা বাসায় আছেন।
উনার সঙ্গে দেখা করে আমাকে কী বলতে হবে?
আপনাকে কিছু বলতে হবে না। আপনি শুধু তার কথা শুনবেন। তার প্রতিটি কথায় সায় দিয়ে যাবেন। তারপর যেখান থেকে এসেছেন সেখানে চলে যাবেন।
ঠিক আছে।
আপনাকে আরেকটা কথা বলার প্রয়োজন মনে করছি।
বলুন।
আপনার মতো খারাপ মানুষ আমি আমার জীবনে দেখি নি। কোনো দিন দেখব এরকম মনে করি না। আপনার দিকে তাকিয়ে থাকতেও আমার ঘেন্না লাগছে।
আমি এক গ্লাস পানি খাব।
বাবার সঙ্গে দেখা করে আপনি চলে যাবেন। আমি আপনাকে পানি এনে দেব না।
অতি রুগ্ন একজন মানুষ বিছানায় লম্বা হয়ে শুয়ে আছে। তার চোখ জ্বলজ্বল করছে। মুখভর্তি খোঁচা খোঁচা সাদা দাড়ি। জাগ্রত মানুষ মূর্তির মতো শুয়ে থাকতে পারে না। সে সামান্য হলেও নড়াচড়া করে। মানুষটা তা করছে না। তাকে দেখে মনে হবে যেমন খুশি সাজো প্রতিযোগিতায় মানুষটা শবদেহ সেজেছে। প্রতিযোগিতায় সে ফার্স্ট প্রাইজ জিতে নেবে এমন সম্ভাবনা আছে। যূথী শবদেহের কাছে গিয়ে বলল–বাবা, মুহিব সাহেব এসেছেন।
শবদেহে সঙ্গে সঙ্গে প্রাণ সঞ্চার হলো। আরজু সাহেব হাতে ভর দিয়ে বিছানায় উঠে বসে অতি পরিচিত ভঙ্গিতে বলল, কখন এসেছ মুহিব?
মুহিব বলল, এই তো কিছুক্ষণ আগে।
আরজু বললেন, সেই কবে তোমার চা খেতে আসার কথা। আমি রোজ দুই তিন বার করে যূথীকে জিজ্ঞেস করি, মুহিব এসেছে? যূথী বলে–না।
মুহিব বলল, আমি ঢাকার বাইরে ছিলাম বলে আসতে পারি নি।
ভদ্রলোক আনন্দিত গলায় বললেন, আমি যূথীকে ঠিক এই কথাই বলেছি। আমি বলেছি মুহিব ঢাকার বাইরে আছে। ঢাকায় থাকলে অবশ্যই আসত। কথা দিয়ে কথা রাখবে না মুহিব এমন ছেলে না। আমি তার নাড়ি-নক্ষত্র চিনি। মুহিব, আমার কথা যদি বিশ্বাস না হয় তুমি যূথীকে জিজ্ঞেস কর।
মুহিব বলল, আপনার কথা বিশ্বাস হবে না কেন? অবশ্যই বিশ্বাস হচ্ছে।
না না, কোনোরকম সন্দেহ থাকা উচিত না। যূথী তুই বল আমি তোকে বলেছি না মুহিব ঢাকায় নেই?
যূথী যন্ত্রের মতো গলায় বলল—হ্যাঁ, বলেছ।
মুহিব বলল— যূথী, আপনি চা নিয়ে আসুন। আপনার বাবার সঙ্গে বসে চা খাই।
আরজু সাহেব বললেন, এখন কী চা খাবে? রাত নটা বাজে। রাত নটার সময় কেউ চা খায়? তুমি ভাত খেয়ে যাবে।
যূথী বলল— বাবা, উনাকে খেতে দেবার মতো কিছু ঘরে নেই।
আরজু সাহেব বিরক্ত গলায় বললেন, মুহিবকে খাওয়ানোর জন্যে কি পোলাও, কোর্মা, কোপ্তা, কালিয়া লাগবে? সে ঘরের ছেলে। যা আছে তাই খাবে।
যূথী কঠিন গলায় বলল— বাবা, ঘরে কিছুই নেই।
শুকনা মরিচ আছে? শুকনা মরিচ ভেজে পেঁয়াজ দিয়ে ডালের ভর্তা বানিয়ে দে। আমি আর মুহিব শুকনা মরিচ দিয়েই ভাত খাব। ডাল যদি থাকে তো ভালো। না থাকলেও কোনো অসুবিধা নেই।
মুহিব বলল, আরেকদিন এসে খেয়ে যাব। আজ আমার একজনের সঙ্গে দেখা করতে যেতেই হবে। কথা দিয়ে রেখেছি। সে অপেক্ষা করে আছে।
ভদ্রলোক বললেন, কথা দিয়ে থাকলে যাও। কথার বরখেলাপ আমার পছন্দ। কাজ সেরে চলে এসো। রাত একটা দুটা তিনটা কোনো অসুবিধা নেই। আমার শরীরটা ভালো না। রাতে এমনিতেই ঘুম হয় না। বলতে গেলে সারারাত জেগেই থাকি। ডাক্তারদের ধারণা মাথায় গণ্ডগোল হয়েছে। চিকিৎসা হচ্ছে। বাবা, তুমি কিন্তু চলে আসবে। যদি রাত বেশি হয়ে যায়, খাওয়া-দাওয়া করে এখানেই শুয়ে থাকবে। আলাদা ঘর আছে। আরাম করে ঘুমাবে।
যূথী মুহিবকে সদর দরজা পর্যন্ত এগিয়ে দিতে এসে চাপা গলায় বলল, আপনি অবশ্যই আসবেন না। অবশ্যই না। আপনাকে খবর দিয়ে আনাই আমার ভুল হয়েছে। বাবাকে সুস্থ করার জন্যে আমার আপনার মতো দুষ্ট মানুষের প্রয়োজন নেই।
মুহিব কিছু বলছে না। চুপ করে দাঁড়িয়ে আছে। যূথী তীব্র গলায় বলল, এত বড় অন্যায় করার পরেও আপনি কিন্তু এখন পর্যন্ত ক্ষমা চান নি।
আপনার বাবার কাছে ক্ষমা চাওয়া ঠিক হবে না। ক্ষমা চাইলেই পুরনো ঘটনা মনে পড়ে যেতে পারে।
একটু দাঁড়ান। পানি খেতে চেয়েছিলেন, পানি নিয়ে আসি।
আমার পানির তৃষ্ণা চলে গেছে। পানি লাগবে না।
মুহিব সিড়ি দিয়ে নেমে যাচ্ছে। একবার পিছন ফিরে তাকাল। যুথী মেয়েটা দরজা ধরে দাঁড়িয়ে আছে। মনে হচ্ছে মেয়েটা কাঁদছে। রাগে-দুঃখে কাঁদছে। কাঁদলেও কি মেয়েটাকে সুন্দর দেখায়? নিশ্চিত হবার জন্যে আরেকবার তাকানো দরকার। মুহিব তাকাল না। রাস্তায় নেমে এলো।
বৃষ্টি বেড়েছে। এখন বড় বড় ফোঁটা পড়ছে। সামান্য বাতাসও দিচ্ছে। রাত বেশি হয় নি, মাত্র নটা বাজে। বৃষ্টি বাদলার কারণে রাস্তায় লোক চলাচল কম। মনে হচ্ছে অনেক রাত। মুহিব মন স্থির করতে পারছে না। সরাসরি নোরাদের বাড়িতে চলে যাবে নাকি প্রেসক্লাব হয়ে তারপর যাবে।
মুহিব রিকশা নিল। রিকশাওয়ালা রিকশার হুড তুলতে গেল। মুহিব বলল, লাগবে না। বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতে যাব। রিকশাওয়ালা সন্দেহ ভরা চোখ নিয়ে তাকাচ্ছে।