জি।
আমার সঙ্গে যোগাযোগ রাখবে। তাহলেই খোঁজ পাবে। তোমার সঙ্গে আমি খারাপ ব্যবহার করেছি, মনে কষ্ট নিও না। তুমি হলে বন্ধুপুত্র, বন্ধুপুত্র পুত্রের মতো। তার সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করার অধিকার আছে। আছে কি-না বলো।
জি আছে। চাচা আমি উঠি।
কিছু মুখে না দিয়ে উঠবে মানে কী? গরম সিঙাড়া দিয়ে চা খাও, তারপর যেখানে ইচ্ছা যাও। চড়ে বেড়াও।
গরম সিঙাড়া কোথায়?
বাসা থেকে আসবে। আমার বড় বৌমা নিজের হাতে বানিয়ে পাঠায়। একটা সিঙাড়া খেলে স্বাদ বাকি জীবন মুখে লেগে থাকবে।
মুহিব চুপচাপ বসে আছে। বসে থাকতে ভালো লাগছে। বৃদ্ধ চেয়ারে পা তুলে আরাম করে বসেছেন। এতক্ষণ চোখে চশমা ছিল না। এখন চশমা পরেছেন। তীক্ষ্ণ চোখে মুহিবকে দেখছেন।
তোমার বাবা সব সময় বলত— আমার ছোট ছেলে গ্রিক দেবতা এপোলোর। চেয়েও সুন্দর। তার কথাকে তেমন গুরুত্ব দেই নাই। বাবা-মারা নিজের সন্তানদের সম্পর্কে এই ধরনের কথা সব সময় বলে। কিন্তু এখন দেখছি তোমার বাবার কথায় অতিরঞ্জন থাকলেও বেশি না। আমি তোমার মতো সুন্দর চেহারার ছেলে একটা দেখেছিলাম। আখাউড়া রেলস্টেশনে। সে কমলা কিনছিল। সেই ছেলের চেহারা এখনো চোখে ভাসে। তোমার সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করেছি— এটা মনে পুষে রাখ নাই তো?
জি না।
আমি নিজের রাগ কমানোর অনেক চেষ্টা করছি। হোমিওপ্যাথিতে একটা ওষুধ আছে থুজা। এর দুইশ পাওয়ার আমার মতো মানুষদের রাগ কমায়। ওষুধ খাচ্ছি, কাজ হচ্ছে না। নিজের ওষুধ নিজের উপর কাজ করে না।
মুহিব বলল, চাচা, রাগ বাড়ানোর কোনো ওষুধ কি আছে?
বৃদ্ধ বিস্মিত হয়ে বললেন, কেন?
মুহিব বলল, রাগ বাড়ানোর ওষুধ থাকলে আমি খেতাম। আমার মধ্যে কোনো রাগ নেই। বাবার কোনো স্বভাব আমি পাই নি, এই একটা স্বভাব পেয়েছি। বাবার যেমন রাগ নেই, আমারও নেই। একটু রাগ থাকলে ভালো হতো।
বৃদ্ধ মুহিবের দিকে তাকিয়ে আছেন। তাঁর চোখ মমতা এবং ভালোবাসায় আর্দ্র।
সন্ধ্যা থেকে টিপটিপ বৃষ্টি পড়ছে। এমন বৃষ্টি যে মাথায় ছাতা ধরতেও ইচ্ছা করে না, আবার ছাতা ছাড়া হাঁটতেও ভালো লাগে না। মুহিব বৃষ্টির ভেতর হাঁটছে। ঝুম বৃষ্টির সময় রিকশা বেবিটেক্সি কিছুই পাওয়া যায় না। টিপটিপ বৃষ্টির সময় একটু পরে পরে খালি রিকশা এসে পাশে থামে। রিকশাওয়ালা আগ্রহ নিয়ে জানতে চায়— কই যাবেন? পারলে জোর করে রিকশায় তুলে নিবে এমন অবস্থা।
মুহিব কোথায় যাবে সে জানে। নোরার কাছে যাবে। নোরা হিপনোটাইজ না কী যেন করবে। কিন্তু মুহিবের মনে হচ্ছে নোরার কাছে যাবার আগে তাকে অন্য কোথাও যেতে হবে। সেটা কোথায় তা মনে পড়ছে না। চেতন মন অবচেতন মনের কোনো ব্যাপার নিশ্চয়ই। সে কোথায় যাবে তা অবচেতন মনে আছে, চেতন মনে নেই।
তার কি মার কাছে যাবার কথা? মাকে সে-রকম কোনো কথা দিয়ে এসেছে? না-কি বড়চাচার কাছে যেতে হবে? বড়চাচা তাকে কিছু কিনতে দিয়েছেন, সে ভুলে গেছে। পাথরের হামানদিস্তা ধরনের কিছু। দি আল মদিনা হোটেলের খায়রুলের সঙ্গে কি ফার্নিচার কিনতে যাবার কথা দিয়ে ভুলে গেছে? কোনো কিছুই মনে পড়ছে না। তার কি আলজেমিয়ার্স ডিজিজ হতে যাচ্ছে? হলে মন্দ হয় না। ক খ গ ঘ থেকে শুরু করা।
নোরাদের বাড়িতে যাবার জন্যে রিকশায় ওঠা মাত্র মুহিবের মনে পড়ল তার আসলে যাবার কথা যূথীদের বাড়িতে। এই সিদ্ধান্ত সে নিজে নেয় নি। কেউ তাকে নিতেও বলে নি। সিদ্ধান্তটা মনের গভীরে কোনো এক অন্ধকার কোণায় লুকিয়ে ছিল। হঠাৎ বের হয়ে এসেছে।
দরজা খুলল যূথী।
মুহিব বলল, আমার নাম মুহিব। আপনি আমার খোঁজ করছিলেন।
যূথী কিছু বলল না। সে দরজা ধরে দাঁড়িয়ে আছে। তার চোখের দৃষ্টি স্থির। মুহিব বলল, আপনি বোধহয় আমাকে চিনতে পারছেন না?
যূথী বলল, চিনতে পারব না কেন? আসুন, ভেতরে আসুন।
মুহিব ঘরে ঢুকল। যূথী বেতের সোফার দিকে আঙুল উঁচিয়ে বলল, বসুন এখানে। যূথীর গলার স্বর কঠিন তবে শান্ত। মুহিব বসল। যূথী বসল ঠিক তার সামনের চেয়ারে। চাইনিজ হোটেলগুলি যেমন অন্ধকার অন্ধকার থাকে, বসার ঘরটাও সেরকম অন্ধকার। যদিও দুটা টেবিল ল্যাম্প জ্বলছে। ঘরে মনে হচ্ছে কোনো লোকজনও নেই। যূথী একা। কোথাও কোনো সাড়াশব্দ নেই। মাথার উপর ফ্যান ঘুরছে। ফ্যানেও শব্দ নেই।
যূথী বলল, আমি আপনাকে খুঁজছিলাম। আপনি যে সত্যি সত্যি আসবেন আমি ভাবি নি। আপনাকে আসতে দেখে আমি অবাকই হয়েছি। বাবাকে এখান থেকে ডেকে নিয়ে গিয়ে যে কাণ্ড করেছেন তারপর আমাদের মুখ দেখানোর কথা না। আপনি সাহসী মানুষ।
মুহিব বসে আছে। তাকিয়ে আছে যূথীর দিকে। তার খুবই পানির পিপাসা হচ্ছে। বুক-গলা শুকিয়ে কাঠ। পানির কথাটা যূথীকে কখন বলবে বুঝতে পারছে না।
যূথী বড় বড় করে নিঃশ্বাস নিচ্ছে। মনে হয় সে নিজেকে সামলাচ্ছে। ঐ রাতে মেয়েটাকে তেমন রূপবতী মনে হয় নি। আজ মনে হচ্ছে। রেগে গেলে কোনো কোনো মেয়েকে সুন্দর লাগে। এই মেয়েটি মনে হয় সেই রকম। মেয়েটি যাকে বিয়ে করবে তার উচিত হবে সারাক্ষণ খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে মেয়েটিকে রাগিয়ে রাখা। মুহিব বলল, আমাকে কেন ডেকেছেন?
যূথী বলল, আপনাকে ডেকেছি বাবার সঙ্গে দেখা করিয়ে দেবার জন্যে। ঐ রাতের ঘটনার পর বাবার মাথায় কোনো কিছু হয়েছে। এলোমেলো কথা বলেন। মাঝে মাঝে আমাকেও চিনতে পারেন না। পিজির একজন সাইকিয়াট্রিস্ট বাবার চিকিৎসা করছেন। পিজির ঐ সাইকিয়াট্রিস্ট প্রফেসর রহমতউল্লা আপনাকে খবর দিয়ে আনতে বলেছেন।