লোকটার কথার ধরনে কলিজা শুকিয়ে যাবার কথা। হারুন অবশ্যি শান্ত গলায় বলেছে, আগামীকাল রাত বারটা এক মিনিটে অবশ্যই আগুন দেয়া হবে। ক্যামেরা আছে? না থাকলে মনে করে ক্যামেরা নিয়ে আসবেন, ছবি তুলে রাখবেন।
চা-ওয়ালা, বাদামওয়ালা, ফুচকাওয়ালারা চলে এসেছে। লোকজন ফুচকা খাচ্ছে। সবার চোখ-মুখ দেখে মনে হচ্ছে তারা মজার কোনো ঘটনার জন্যে অপেক্ষা করছে। বিদেশী দুই সাহেবও এসেছেন। তারা ছোট ভিডিও ক্যামেরায় প্রচুর ছবি তুলেছেন। ছবি তোলার পর তারা চলে গেলেন না। খুবই মজা করে ফুচকা খাচ্ছেন।
খায়রুল সফিককে আড়ালে ডেকে নিয়ে বলল— সফিক ভাই, অবস্থা তো খুব খারাপ।
সফিক বলল, খারাপ বলছেন কেন?
আগামীকালের কথা চিন্তা করে কলিজায় পানি চলে এসেছে। মানুষ এখন পিশাচ হয়ে গেছে। গায়ে আগুন না দেখে এরা যাবে না।
সফিক চিন্তিত গলায় বলল, সে-রকমই তো মনে হচ্ছে।
খায়রুল বলল, প্রয়োজনে এরা নিজেরা হারুন ভাইয়ের গায়ে কেরোসিন ঢেলে আগুন দিয়ে দিবে।
সফিক বলল, পালায়ে যাওয়া যায় না?
খায়রুল চিন্তিত গলায় বলল, পালাইতে গেলে শক্ত মাইর খাওয়ার সম্ভাবনা।
সফিক বলল, কথা ভুল বলেন নাই। সব সাইকোলজি বোঝা মুশকিল। দেখা যাবে আমাদের সবার গায়েই কেরোসিন ঢেলে আগুন দিয়ে দিয়েছে। সবাই এক সঙ্গে কয়লা হয়ে গেলাম।
এক পত্রিকা থেকে হারুনের ইন্টারভিউ নিতে এসেছে। চিড়িং বিড়িং টাইপ বাইশ-তেইশ বছরের মেয়ে। চোখেমুখে কথা বলে। হারুন ইন্টারভিউ দিচ্ছে। কী বলতে কী বলে ফেলে এই ভয়ে মহসিন তাকে সাহায্য করতে গিয়েছিল। মেয়েটি তার দিকে তাকিয়ে বলেছে, আপনিও কি আত্মাহুতিতে আছেন?
মহসিন বলল, না। মেয়েটি বলল, তাহলে আপনি কথা বলবেন না। যেদিন আপনিও আত্মাহুতির সিদ্ধান্ত নেবেন সেদিন আপনার ইন্টারভিউ নেব।
এই ধরনের মেয়েরা প্যাচে ফেলে অনেক গোপন কথা বের করে ফেলে। কিন্তু হারুন বেশ সহজভাবেই কথা বলছে। তাকে পঁাচে ফেলা যাচ্ছে না।
আপনি নিশ্চিত যে আগামীকাল রাত বারটা এক মিনিটে গায়ে কেরোসিন ঢেলে আগুন দেবেন?
হ্যাঁ, আমি নিশ্চিত।
গায়ে আগুন দেবার আগে যে কথাগুলি সবার উদ্দেশে বলবেন সেগুলি কি এখন বলবেন? আমি লিখে নিতে পারি।
তখন কী বলব তা তো জানি না।
আপনার বাবা আপনার মা— তারা এই ব্যাপারটা কীভাবে নিচ্ছেন?
আমি জানি না। তাদের জিজ্ঞেস করুন।
আমার কাছে কিন্তু মনে হচ্ছে পুরো ব্যাপারটাই সাজানো নাটক। আগামীকাল সন্ধ্যার পর থেকে আপনাকে এখানে পাওয়া যাবে না।
আপনার কী মনে হচ্ছে না হচ্ছে সেটা আপনার ব্যাপার।
কী খাচ্ছেন?
চা খাচ্ছি। আলুর চপ খাচ্ছি। আমি অনশন করছি না। আমার খেতে বাধা নেই। আপনি চা খাবেন? দিতে বলি?
সফিক দূরে দাঁড়িয়ে বলল, খাল কেটে কুমীরের বদলে পাবলিক নিয়ে এসেছি। কুমীর সামলানো যায়। পাবলিক যায় না। আমাদের সামনে মহাবিপদ।
মুহিব তার বাবার বাসার সামনে দাঁড়িয়ে আছে। ঘর তালা দেয়া। সে চিন্তিত বোধ করল না। নিউ হোমিও হল খোলা আছে। এখানে আসার পথে চোখে পড়েছে। বুড়ো এক চশমা পরা ভদ্রলোক কুঁজো হয়ে খবরের কাগজ পড়ছেন। তার কাছে গেলেই খোঁজ পাওয়া যাবে।
ডাক্তার সাহেবের নাম হাবীবুল্লাহ। বয়স সত্তরের কাছাকাছি। তিনি খবরের কাগজ থেকে একবার চোখ তুলে মুহিবকে দেখলেন। সে কী জন্যে এসেছে তা শুনলেন। হাত ইশারায় তাকে বসতে বলে আবারো কাগজ পড়তে লাগলেন। মুহিব কাঠের বেঞ্চে চুপচাপ বসে রইল। সকালবেলার বাসি খবরের কাগজ সে এর আগে কাউকে এত আগ্রহ করে পড়তে দেখে নি।
এক সময় তাঁর কাগজ পড়া শেষ হলো। তিনি মুহিবের দিকে কঠিন চোখে তাকালেন।
শামসুদ্দিন সাহেব তোমার পিতা?
জি।
পিতার খোঁজে এসেছ?
জি।
কে বলেছে যে আমি তার খোঁজ জানি?
আপনি জানেন না?
জানলেও বলব না।
বলবেন না?
না। বৃদ্ধ পিতা। অসুস্থ, জ্বরে কাতর। তাকে বাড়ি থেকে পুলিশ দিয়ে বের করে দিয়েছে। জ্বরের কারণে সে দাঁড়িয়ে থাকতে পারছে না— আর আজ তুমি এসেছ পিতার খোঁজে? ফিটফাট বাবু সেজে এসেছ, গলায় টাই।
মুহিব চুপ করে আছে। বৃদ্ধকে রাগ কমানোর সময় দিতে হবে। খুব যারা রাগী তাদের রাগ ঝপ করে পড়ে যায়। তখন তাদের প্রতিটি কথা মায়ায় ড়ুবানো থাকে। এই বৃদ্ধের রাগ এক্ষুণি পড়বে।
তোমার নাম কী?
মুহিব।
ও! তাহলে তোমার নামই হুঁ-বাবা?
জি।
তোমার পিতা একবার খুবই অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিল। আজরাইলে-মানুষে দড়ি টানাটানি। আমি রোজ সন্ধ্যায় তোমার বাবার বিছানার পাশে বসে থাকতাম তখন তো তোমাকে দেখি নাই। কোথায় ছিলা? ফূর্তি করতে ছিলা?
আমি খবর পাই নি। আমি সব সময় যে বাবার কাছে আসি তা-না। হঠাৎ হঠাৎ আসি।
তুমি তো দেখি বিরাট লায়েক পুত্র। হঠাৎ হঠাৎ আস। দরকার কী হঠাৎ হঠাৎ আসার? গলায় টাই বেঁধে বন্ধুদের সঙ্গে ঘুরে বেড়াও। মদ খাও না তুমি? অবশ্যই খাও। চেহারা দেখেই বোঝা যাচ্ছে মদ খাওয়া লালটু চেহারা। তোমার সঙ্গে কথা বলা মানে সময় নষ্ট। মনের শান্তি নষ্ট। তুমি বিদায় হও।
মুহিব বসে রইল। খুবই আশ্চর্যের ব্যাপার, বৃদ্ধের রাগারাগি শুনতে তার ভালো লাগছে। বৃদ্ধের গলায় রাগ আছে কিন্তু চোখে মায়া চলে এসেছে।
হুঁ-বাবা, আমার কথা মন দিয়ে শোন তোমার পিতা কোথায় আছেন আমি জানি না। তিনি বলেছেন কোনো একটা থাকার জায়গা খুঁজে বের করে আমাকে জানিয়ে যাবেন। বুঝতে পেরেছ?