নোরা শান্ত গলায় বলল, আমার বাবা এই কোম্পানির মেজর শেয়ার হোল্ডার। আমি চারজন ডিরেক্টরের একজন।
তার মানে চাকরিটা পাওয়ার পেছনে তোমার অবদান আছে?
যদি থাকে তাতে কোনো সমস্যা আছে?
না কোনো সমস্যা নেই।
মুহিব শোন, তোমার চাকরি পাওয়ার পেছনে আমার সামান্য ভূমিকার কারণে যদি তোমার ভেতর কোনো গ্লানিবোধ তৈরি হয় সেটা আমি দূর করে দেব। খুব সহজেই দূর করে দেব।
কীভাবে? হিপনোসিসের মাধ্যমে? হিপনোটিক সাজেশান?
হ্যাঁ।
তাহলে তো ভালোই হয়। শুধু গ্লানিবোধ কেন? আমার মনে আরো অনেক অদ্ভুত অদ্ভুত বোধ আছে। সব দূর করে দাও।
টেলিফোন রেখে মুহিব তার গলার টাই সামান্য আলগা করে দিল। গলায় ফঁসের মতো লাগছিল, এখন আরাম লাগছে। খানিকটা ঘুম ঘুমও পাচ্ছে। সোফাজাতীয় কিছু থাকলে লম্বা হয়ে শুয়ে ঘুমিয়ে পড়া যেত।
দুপুরে শিকদার সাহেব মুহিবকে নিয়ে অফিসের ক্যান্টিনে লাঞ্চ খেতে গেলেন। বিদেশী কায়দার লাঞ্চ। একটা স্যান্ডউইচ, একটা আপেল, এক বাটি স্যুপ। টক-ঝাল স্যুপটা খেতে অসাধারণ।
শিকদার সাহেব বললেন, চাকরি কেমন লাগছে?
মুহিব বলল, ভালো লাগছে। শিকদার সাহেব বললেন, এই কোম্পানির চাকরি মোটামুটি আরামের, কাজের চাপ কম। তবে শুনতে পাচ্ছি বিদেশী কোনো এক কোম্পানির সঙ্গে নাকি যুক্ত হবে। তখন কী হবে কে জানে।
মুহিব বলল, আপনাকে দেখে মনে হচ্ছে আপনি বুদ্ধিমান মানুষ। ফাকি দিতে চাইলে একটা না একটা বুদ্ধি আপনি নিশ্চয়ই বের করতে পারবেন।
শিকদার সাহেব গম্ভীর গলায় বললেন, আপনি কী বুঝাতে চাচ্ছেন ধরতে পারছি না।
মুহিব বলল, আমি কিছু বুঝাতে চাচ্ছি না। রসিকতা করছি। আপনাদের অফিসে রসিকতা করা যায় তো?
আপনাদের অফিস বলছেন কেন? অফিসটা তো আপনারও।
মুহিব বলল, না। আমার অফিস না। আমি আপনাদের বড় সাহেবের জন্যে অপেক্ষা করছি। উনি এলেই রেজিগনেশন লেটার উনার হাতে ধরিয়ে পগারপার হয়ে যাব।
রেজিগনেশন লেটার দেবেন কেন? কারণটা কী?
মুহিব হাসিমুখে বলল, হোমোসেপিয়ানসরা খুবই বিচিত্র প্রাণী। তারা বেশির ভাগ কাজ করে কোনো কারণ ছাড়া। এটা আমার কথা না। আপনাদের অফিসের চারজন ডিরেক্টর-এর একজনের কথা।
আপনি কি সত্যি চাকরি করবেন না?
না।
শিকদার সাহেব এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন। মুহিবের কথাগুলো তিনি ঠিক বিশ্বাস করতে পারছেন না। আবার অবিশ্বাসও করতে পারছেন না। মুহিব বলল, আমি আরেকটা স্যুপ খাব।
দি আল মদিনা রেস্টুরেন্টের মালিক
দি আল মদিনা রেস্টুরেন্টের মালিক গত দুদিন ধরে উত্তেজনাময় সময় কাটাচ্ছে। সে সার্বক্ষণিকভাবে সফিকদের সঙ্গে আছে। দৌড়াদৌড়ি ছোটাছুটি করছে। তার খুবই ভালো লাগছে। সবাই তার নাম দিয়েছে হংস বাবু। এতেও সে খুব মজা পাচ্ছে। হংস বাবু ডাকলেও সবাই যে তার মতামতকে গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করছে এতেই সে আনন্দিত। লেখাপড়া জানা শিক্ষিত সব ছেলে। এমএ, বিএ পাস। তার মতো মূর্খ হোটেল মালিকের সঙ্গে এদের কথা বলারই কথা না। অথচ কী আশ্চর্য কথা! গুরুত্বপূর্ণ যে-কোনো সিদ্ধান্তের সময় তার মতামত জানতে চাওয়া হচ্ছে।
টেলিভিশনওয়ালারা ছবি তুলতে এসেছিল। সেখানে তারা অনেকের সঙ্গে তাকেও প্রশ্ন করেছে। সে ঠিকঠাক মতো জবাব দিয়েছে। সফিক ভাই বলেছেন। জবাব ভালো হয়েছে। টেলিভিশনওয়ালারা জিজ্ঞেস করেছে— আপনার নাম কী?
খায়রুল বলেছে, জনাব, আমার নাম খায়রুল। আমি আল মদিনা হোটেলের মালিক।
এদের সঙ্গে আপনার সম্পর্ক কী?
খায়রুল ফ্যাসফ্যাসে গলায় কিন্তু স্পষ্ট করেই জবাব দিয়েছে। সে বলেছে, জনাব, আমি প্রথমে মজা দেখতে আসছিলাম। পরে দেখলাম বড়ই জটিল ঘটনা। আর যাইতে পারলাম না।
জটিল ঘটনা বলছেন কেন?
একটা শিক্ষিত জোয়ান ছেলে গায়ে আগুন লাগায়ে মরে যাবে। জটিল ঘটনা না?
আজ এক তারিখ ঘোষণা অনুযায়ী আগামীকাল রাত বারটা এক মিনিটে হারুনের গায়ে আগুন লাগাবার কথা। সময় দ্রুত এগিয়ে আসছে। সফিক মোটামুটি নিশ্চিত ছিল— আজ দিনের মধ্যেই সরকার পক্ষের কেউ না কেউ আসবে। সরকার বেকার সমস্যার সমাধানের জন্যে যে-সব গুরুত্বপূর্ণ এবং যুগান্তকারী সিদ্ধান্ত নিয়েছে তা জ্বালাময়ী ভাষায় বলবে। গায়ে আগুন দেয়াটা ধামাচাপা দেয়া যাবে। এখন পর্যন্ত সে-রকম কিছু ঘটে নি। যুব মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী বলেছিলেন আজ সকালে আসবেন। এখন জানা গেছে তিনি তার এলাকায় গেছেন। দুদিন থাকবেন।
বিরোধী দলের কেউ এগিয়ে এলেও হতো। তাদের জন্যে এটা ভালো সুযোগ। এই ইস্যুতে তারা সরকারকে ধুয়ে ফেলতে পারবে। এমন একটা মারাত্মক ইস্যু কিন্তু বিরোধী দলের কোনো আগ্রহ দেখা যাচ্ছে না। শেষ ভরসা কবি-সাহিত্যিকদের কেউ।
মহসিন গিয়েছিল কবি শামসুর রাহমান সাহেবের কাছে। হাতে-পায়ে ধরে তাকে যদি রাজি করানো যায়। তিনি আসবেন, আবেগময় ভাষায় কিছু কথা বলবেন। তারপর হারুনকে উঠিয়ে নিয়ে চলে যাবেন। মহসিন ফিরে এসেছে। কবি খুবই অসুস্থ। আসতে পারবেন না।
বিকেল থেকেই লোক জমতে শুরু করেছে। এমন জনসমাগমে খুশি হওয়া উচিত। সফিক খুশি হতে পারছে না। তার কাছে মনে হচ্ছে লক্ষণ ভালো না। আজই এত লোক, আগামীকাল না জানি কত হবে। পাবলিক মজা দেখার জন্যে আসবে। তাদেরকে ঠিকমতো মজা দিতে না পারলে সমস্যা আছে।
ষণ্ডাগুণ্ডা ধরনের এক লোক এসে হারুনকে বলেছে, আগুন কি সত্যই দিবেন? ভাওতাবাজি না তো? ফুটবেন না তো?