তৌফিকুর রহমান উৎসাহিত গলায় বললেন, ভালো কথা মনে করেছিস। আমিও নাম নিয়ে ভাবছি। কয়েকটা নাম মনে এসেছে। তুইও চিন্তা-ভাবনা কর। যে-সব নাম মাথায় আসে একটা কাগজে লিখে ফেল। তারপর একদিন বসে নাম সিলেক্ট করে ফেলব।
মুহিব বলল, এই মুহূর্তে আমার মাথায় একটা নাম ঘুরঘুর করছে। জলপাইবটিকা। নামটা আপনার কাছে কেমন লাগছে?
তৌফিকুর রহমানের মুখ সঙ্গে সঙ্গে কঠিন হয়ে গেল। তিনি কড়া গলায় বললেন, জলপাই-বুটিকা মানে?
মুহিব মিনমিন করে বলল, দেশী ওষুধের দেশী নাম।
তৌফিকুর রহমান গম্ভীর গলায় বললেন, তার কথার ধরন দেখে আমার মনে হচ্ছে, তুই পুরো ব্যাপারটি খুব হালকাভাবে দেখছিস। আমি এনয়েড বোধ করছি। আমি আর দশটা পেনশন খাওয়া মানুষের মতো না। আমি কোনো খেলা খেলছি না। আচ্ছা ঠিক আছে, এখন যা। তোর সঙ্গে পরে এই নিয়ে কথা হবে।
মুহিব সিঁড়ি দিয়ে নামার সময় বাঁ চোখে একবার হাত দিল। যা ভাবা গেছে তাই। জল-চিকিৎসায় উল্টা রিঅ্যাকশন হয়েছে। চোখ আরো ফুলেছে। বড়চাচার চোখে পড়ে নি। পড়ার কথাও না। তিনি কারোর মুখের দিকে তাকিয়ে কথা বলেন না। মুহিবের ধারণা— তিনি যদি সরাসরি তার মুখের দিকে তাকিয়েও কথা বলতেন তাহলেও চোখে পড়ত না।
মুহিবের মা মনোয়ারা রান্নাঘরে। চুলা থেকে দূরে দেয়ালের সঙ্গে পিঠ ঠেকিয়ে উঁচু জলচৌকিতে বসে আছেন। রান্নাবান্না তদারকির জন্যে তিনি অর্ডার দিয়ে জলচৌকিটা বানিয়ে নিয়েছেন। জলচৌকির উপর নারিকেলের ছোবড়া গদিও আছে। সকালের নাশতার সময় তিনি এসে জলচৌকিতে বসেন। দুপুরে রান্না না হওয়া পর্যন্ত সেখানেই থাকেন। সবকিছু তার চোখের সামনে হতে হয়। তাওয়া থেকে পরোটা নামানোর সময় প্রতিটি পরোটা তাকে দেখিয়ে নিতে হয়। তিনি সারাক্ষণই নির্দেশ দিতে থাকেন— মতির মা! এর নাম পরোটা ভাজা? এক পিঠ হয়েছে আরেক পিঠ কাঁচা। তেলে চপচপ করছে। আমার কি তেলের খনি আছে? একটা পরোটার জন্য যে পরিমাণ তেল দিয়েছ এই তেলে ছোটখাট দুটা পরিবারের এক মাসের রান্না হয়। তোমাকে দিয়ে আমার পোষাবে না মতির মা। তুমি বরং বাংলাদেশের প্রেসিডেন্ট সাহেবের বাড়িতে বাবুর্চির কাজ পাও কি-না দেখ। আমার বাড়িতে তোমাকে দিয়ে হবে না।
মনোয়ারার অভ্যাস ঘনঘন চা এবং জর্দা দিয়ে পান খাওয়া হয় তার মুখে ময়মনসিংহের স্পেশাল জর্দার পান থাকবে আর নয়তো চা থাকবে। মুখ কখনো খালি থাকবে না। মাঝে মাঝে দুটাই এক সঙ্গে থাকে। গালের এক পাশে পান। জর্দা রেখে দিয়ে অন্য পাশ দিয়ে তিনি না-কি চা খেতে পারেন। তাঁর কোনোই সমস্যা হয় না। তিনি প্রেসারের রোগী। রান্নাঘরে চুলার গরমে তাঁর থাকা নিষেধ, কিন্তু তিনি থাকবেন। এবং তার দুই পুত্রবধূর কারোর না কারোর সঙ্গে একটা ঝগড়ার সূত্রপাত করবেন। এই ঝগড়া তিনি একাই অনেকদূর টেনে নিয়ে যাবেন। রাগ দেখিয়ে দুপুরে ভাত না খেয়ে দরজা বন্ধ করে ঘুমুতে যাবেন। অনেক সাধ্য সাধনা করে সন্ধ্যাবেলায় তার রাগ ভাঙানো হবে। তিনি অবেলায় খেতে বসবেন। ভাত খাবার ঘণ্টাখানিকের মধ্যে তার মেজাজ পুরোপুরি ঠিক হয়ে যাবে। যার সঙ্গে ঝগড়া হয়েছে রাতে তাকে পাশে নিয়েই ডিভিডি প্লেয়ারে হিন্দি ছবি দেখতে বসবেন। ডিভিডি প্লেয়ারটা তার মেজো মেয়ের জামাই সৌদি আরব থেকে পাঠিয়েছে। এটা তার শোবার ঘরে টেলিভিশনের সঙ্গে সেট করা। তিনি প্রতি রাতে ঘুমুবার আগে একটা ছবি দেখেন। এই সময় বাড়ির সব মেয়েকে (কাজের দুটি মেয়েসহ) তার পাশে থাকতে হয়। ছবি দেখা তার অভ্যাসের মতো হয়ে গেছে। যে রাতে তিনি ছবি দেখতে পারেন না সে রাতে তাঁর ঘুম হয় না। প্রেসারে সমস্যা হয়। নিচেরটা ১২০-১২৫ হয়ে যায়।
মুহিব মায়ের খোঁজে রান্নাঘরে ঢুকল। মুহিবের আসল উদ্দেশ্য তার চোখ ফোলাটা মার নজরে পড়ে কি না। মুহিব বলল, মা চা হবে?
মনোয়ারা বললেন, না, চুলা দুটাই বন্ধ।
তোমার লাগবে কিছু? নিউ মার্কেটে যাব।
ভিডিওর দোকান থেকে একটা ছবি নিয়ে আসিস।
কী ছবি আনব, নাম বলল।
কয়লা নামে কোনো ছবি আছে কি-না দেখিস তো। বোবার কাহিনী। শাহরুখ খান আছে, মাধুরী আছে, অমরেশপুরী আছে। সবাই দেখে ফেলেছে, আমার দেখা হয় নি।
জর্দা-টর্দা কিছু লাগবে না?
না। রান্নাঘরে এতক্ষণ থাকবি না। কাজের মেয়েরা রান্নাঘরে থাকে। রান্নার সময় এদের কাপড়-চোপড়ের দিকে নজর থাকে না। এই জন্যে পুরুষ মানুষের রান্নাঘরে ঘুরঘুর আমার খুবই অপছন্দ।
মা, একটু দেখ না এক কাপ চা দেয়া যায় কি-না।
বললাম তো না। একটা কথা পঞ্চাশবার করে বলতে হবে?
মুহিব রান্নাঘর থেকে বের হলো। তার চোখের অবস্থা মনোয়ারার নজরে পড়ল না। খুবই আশ্চর্যের ব্যাপার! সে কি সত্যি সত্যি ইনভিজিবল ম্যান হয়ে যাচ্ছে? সব বেকার যুবকের ক্ষেত্রেই কি এটা ঘটে? থাকে মানুষ এক সময় হয়ে যায় ছায়া মানুষ। Shadow Man.
খাবার ঘরের ডাইনিং টেবিলে নাশতা দেয়া হয়েছে। মুহিবের বড় দুই ভাই পাশাপাশি গম্ভীর মুখে বসে আছে। দুজনকেই চরম বিরক্ত বলে মনে হচ্ছে। বড় ভাই তোফাজ্জল করিমের হাতে খবরের কাগজ। খবরের কাগজ আগে কেউ পড়ে ফেললে সে পড়তে পারে না। এই কারণেই ইয়াসমিন বাড়িতে খবরের কাগজ আসা মাত্র স্বামীর হাতে তুলে দেয়। সকালবেলার মতো ইয়াসমিনের কাজ শেষ। সে চায়ের কাপ হাতে নিজের ঘরে ঢুকে যায়। সবার নাশতা খাওয়া শেষ হবার পর বাড়ি যখন নীরব হয় তখন সে ধীরে সুস্থে নাশতা খেতে বের হয়। কোনোরকম হৈচৈ ইয়াসমিনের পছন্দ হয় না। তার মাথা ধরে যায়।