আমি কে তা দিয়া আপনার প্রয়োজন নাই। যারে প্রয়োজন তার কাছে যান।
মুহিব ঘরে ঢুকে দেখল তার বাবা তোক বিহীন বিছানায় পা ঝুলিয়ে বসে আছেন। ঘরের সব জিনিসপত্র বাধাছাদা করা হয়েছে। শামসুদ্দিন সাহেব ছেলেকে দেখে অবাকও হলেন না, খুশিও হলেন না। অদ্ভুত চোখে তাকিয়ে রইলেন। মুহিব বলল, ঘটনা কী বাবা? এই বাড়ি ছেড়ে দিচ্ছ?
শামসুদ্দিন সাহেব ক্লান্ত গলায় বললেন, হুঁ। কয়টা বাজে দেখ তো!
আটটা চল্লিশ।
দশটার ভেতর ছেড়ে দিতে হবে। না হলে অসুবিধা আছে।
কী অসুবিধা?
শামসুদ্দিন জবাব দিলেন না। মুহিব বলল, বাবা তোমার কি শরীর খারাপ?
সামান্য জ্বর আছে।
মুহিব গায়ে হাত দিয়ে চমকে উঠে বলল, সামান্য কোথায়? জ্বর তো অনেক। এই জ্বর নিয়ে যাবে কোথায়? কিছু ঠিক করেছ?
না। আপাতত কোনো হোটেলে উঠব।
কোন হোটেলে?
কিছু ঠিক করি নাই। তুই দুশ্চিন্তা করিস না।
বাবা, তোমার অবস্থা দেখে আমার খুবই খারাপ লাগছে। তোমার শরীর অসম্ভব খারাপ। আমি কী বলছি না বলছি তাও মনে হয় তুমি বুঝতে পারছ না।
শামসুদ্দিন ক্লান্ত গলায় বললেন, বুঝতে পারছি।
মুহিব বলল, বাবা, আমি একটা চাকরি পেয়েছি। ভালো বেতনের ভালো চাকরি। আমি এসেছি তোমাকে সালাম করতে। তুমি আজকের দিনটা এ বাড়িতে থাক। আমি সন্ধ্যার আগে আগেই তোমাকে নিয়ে যাব।
কোথায় নিয়ে যাবি?
সেটা তখন ঠিক করব। আজ দিনটা এ বাড়িতে তোমাকে থাকতে দেবে না?
দিবে।
বাবা, তুমি খুব মন দিয়ে শোন, আমি কী বলছি। তুমি অনেক কষ্ট করেছ, তোমাকে আর কষ্ট করতে হবে না। তুমি আমার সঙ্গে থাকবে।
তোর বৌ তো রাগ করবে রে ব্যাটা।
বাবা, তোমার মাথা তো মনে হয় এলোমেলো হয়ে গেছে। আমি এখনো বিয়ে করি নি।
এক সময় তো করবি।
যখন করব তখন দেখা যাবে। বাবা, আমি তোষক বিছিয়ে দিচ্ছি। তুমি চাদর গায়ে দিয়ে শুয়ে থাক। আমি অফিস শেষ করে তোমাকে এসে নিয়ে যাব।
আচ্ছা। তুই আমার জ্বর নিয়ে চিন্তা করিস না। আমার জ্বর বেশিক্ষণ থাকে না।
আশেপাশে কোনো ডাক্তার বসেন? তাহলে আমি তাকে বলে যেতে পারি তোমাকে এসে দেখে যাবেন।
নিউ হোমিও হলের ডাক্তার সাহেব আছেন। আমার বন্ধু মানুষ। উনাকে বলে গেলেই হবে।
আমি তাকে বলে যাচ্ছি।
শামসুদ্দিন সাহেব ছেলের পিঠে হাত রেখে বললেন, তুই এত দুশ্চিন্তা করছিস কেন? আমার জ্বর কমে যাচ্ছে।
নিউ হোমিও হল বন্ধ। দশটার আগে খুলবে না। মুহিব ঘড়ি দেখল।
নয়টা দশ বাজে। আর সময় নষ্ট করা ঠিক হবে না। অফিসের সময় হয়ে গেছে। জয়েনিং এর দিনে এক ঘণ্টা দেরি করে উপস্থিত হলে খবর আছে। মুহিব একটা বেবিটেক্সি ভাড়া করল। বেবিটেক্সিতে উঠার পর পরই তার মনে হলো অফিসে পৌঁছানোর পর সে দেখবে চিচিং ফাঁক। চাকরি নেই। বস শ্রেণীর কেউ গম্ভীর গলায় বলবেন, সরি, কোম্পানির আর্থিক অবস্থা ভালো না এই জন্যে নতুন রিক্রুটিং আপাতত বন্ধ। মাস ছয়েক পর খোঁজ নেবেন। বুঝতেই পারছেন World wide রিসিশান যাচ্ছে। প্রচুর লে অফ হচ্ছে। বলুন কী খাবেন? চা—কফি।
সে চা খেতে চাইবে। যে বেয়ারা চা নিয়ে আসবে সে সিরিয়াস ধরনের মুখের ভঙ্গি করে রাখবে। তাচ্ছিল্যের হাসি ঠোঁটের কোণায় থাকবে। তবে তা ঠিক ধরা যাবে না। চা শেষ করে অফিস থেকে বের হবার সময় সবাই বিশেষ চোখে একবার করে হলেও তার দিকে তাকাবে। কেউ হয়তো বা বলবে— টাই লাগিয়ে মাঞ্জা দিয়ে চলে এসেছে। মাঞ্জায় কাজ হবে না রে বাবা।
জয়েন করতে মুহিবের কোনো সমস্যা হলো না। শিকদার নামের এক ভদ্রলোক তার দিকে হাত বাড়িয়ে বললেন, ওয়েলকাম। থ্যাংকয়ুর উত্তরে ওয়েলকাম বলতে হয়। ওয়েলকামের উত্তরে কী বলতে হয়? বোকার মতো হাসা কি ঠিক হচ্ছে? মুহিব পরিষ্কার বুঝতে পারছে— তার ঠোঁটের কোণায় বোকা বোকা টাইপ একধরনের হাসি ঝুলে আছে।
ঘরের মেঝে অতিরিক্ত মসৃণ। মুহিবের কেবলই মনে হচ্ছে যে-কোনো মুহূর্তে সে পা পিছলে উল্টে পড়ে যাবে। অফিসের সবার জন্যে দৃশ্যটা অবশ্যই মজার হবে। একেকজন একেক রকম শব্দ করে হাসবে। হাঁটাহাঁটি না করে কোনো একটা ঘরে চুপচাপ বসে থাকতে পারলে হতো। আচ্ছা এরা কি তাকে আলাদা কোনো ঘর দেবে? মনে হয় না। চাকরির পোস্টটা কী তা এখনো জানা হলো না। সে কি শিকদার সাহেবকে জিজ্ঞেস করবে? আগ বাড়িয়ে এত উৎসাহ দেখানো কি ঠিক হবে? একজন কেউ যদি থাকত যে বলে দেবে কী ঠিক হবে কী ঠিক হবে না।
মুহিব তার নিজের ঠাণ্ডা ঘরে বসে আছে। কোনো অফিসের উপরের দিকের অফিসারদের ঘরের মতো ঘর। পিসি, টেলিফোন, ইন্টারকম, রিভলভিং চেয়ার সবই আছে। মুহিব জবুথবু হয়ে বিভলভিং চেয়ারে বসে আছে। তার সামনে শিকদার সাহেব। ভদ্রলোক হাস্যমুখী। মুখে সারাক্ষণ হাসি। শব্দহীন হাসি। মুহিব কোথায় যেন পড়েছিল যে পুরুষ নিঃশব্দে হাসে তাহার বিষয়ে সাবধান।
মুহিব সাহেব।
জি।
এই আপনার ঘর। ঘরের ইন্টেরিয়র যদি চেঞ্জ করতে চান, করবেন। পছন্দের কোনো পেইনটিং লাগাতে চাইলে লাগাতে পারেন।
জি আচ্ছা।
আজ আপনার কোনো কাজ নেই। নিজেকে ধাতস্ত করুন। সবার সঙ্গে আলাপ-পরিচয় করুন। টেলিফোনে বন্ধু-বান্ধবদের সঙ্গে কথা বলুন। রিলাক্স করুন।
জি আচ্ছা।
আমার কাছে কিছু জানতে চাইলে জিজ্ঞেস করতে পারেন।
মুহিব বলল, আমার কাজটা কী?
শিকদার সাহেব বললেন, আপনার কাজ হলো চেয়ারে বসে থাকা। হা হা হা।
ভদ্রলোক এই প্রথম শব্দ করে হাসছেন। কাজেই শব্দ করে হাসার ব্যাপারটা ভদ্রলোক যে জানেন না তা-না। যারা মাঝে মাঝে শব্দ করে হাসে তাদের বিষয়ে নিশ্চয়ই সাবধান হবার কিছু নেই।