মুহিব জবাব দিল না।
বুলু বলল, তোকে বাড়ি থেকে বের করে দিয়েছে— এটা কি সত্যি? নিজের ভাই বাড়ি থেকে বের করে দেয়— কী লজ্জার কথা! না-কি তোর লজ্জা লাগছে না।
মুহিব বলল, আমিও খানিকটা বাবার মতো লজ্জাহীন। আপা, আমি যাচ্ছি।
মুহিবের ঘড়িতে বাজছে সাড়ে সাতটা। হাতে অনেক সময় আছে। মতিঝিল পৌঁছতে আধ ঘণ্টার মতো লাগবে। প্রেসক্লাবের সামনে কিছুক্ষণের জন্যে থামলে কেমন হয়? মুহিব এই চিন্তাকে প্রশ্রয় দিল না।
একবার নামলে আটকা পড়ে যেতে হবে। অফিস থেকে সরাসরি প্রেসক্লাবের সামনে ফিরলেই হবে। তারচে বরং বাবার সঙ্গে দেখা করে আসা যায়। মাকে সালাম করা হয়েছে। বাবাকে সালাম করা হয় নি। বন্ধুত্বের উপর কবি ইয়েটস-এর দু লাইন কবিতা লিখিয়ে নিয়ে আসতে হবে। জটিল কবিতা, দুলাইন শুনলে মুখস্থ হবে— এমন স্মৃতিশক্তি তার নেই।
প্রেসক্লাবের সামনে যাবে না যাবে না ভেবেও মুহিব সেখানেই আগে গেল। শুধু বাবাকে না, সফিককেও সালাম করতে ইচ্ছা করছে।
প্রেসক্লাবের সামনে সফিক একা বসে আছে। হারুন যে সতরঞ্জির উপর বসে ছিল সেটা খালি। তবে পোস্টারে পোস্টারে চারদিক ছয়লাপ। ছোট একটা তবুও খাটানো হয়েছে। প্লাস্টিকের চেয়ারগুলি এখন তাঁবুর ভিতর। সফিক অসম্ভব বিরক্ত। গত দুদিনে শেভ করে নি বলে খোঁচা খোঁচা দাড়ি বের হয়ে তাকে দেখাচ্ছে পুরোপুরি জংলির মতো।
সফিক মুহিবের দিকে তাকিয়ে রাগী গলায় বলল, তোর ঘটনা কী? এখানে কত সিরিয়াস ব্যাপার, আর তুই ড়ুব মারলি? রাতে একবার আসবি না? দোকানদার একটাকে পাঠিয়ে দিয়েছিস খায়রুল না বায়রুল কী যেন নাম— গলা দিয়ে শব্দ বের হচ্ছে না, তারপরেও সারাক্ষণ কথা। সে তো এসেই হারুনকে মিরপুরে তার কোন শাড়ির দোকানে চাকরি দিয়ে দিল। এইসব বেকুব তুই কোত্থেকে জোগাড় করিস?
মুহিব কিছু বলল না।
তুই না-কি ঐ বেকুবের বাড়িতে গিয়ে উঠেছিস? কেন? বাড়ি থেকে লাথি দিয়ে বের করে দিয়েছে?
ব্যাপারটা সে-রকমই।
ভালোই হয়েছে, রাতে আড্ডা দেবার একটা জায়গা হয়েছে।
সফিক সিগারেট ধরাল। তার মেজাজ ঠাণ্ডা হয়ে আসছে এটা বোঝা যাচ্ছে। সে নরম গলায় বলল, তোর কি আজ চাকরিতে জয়েনিং? সাজসজ্জা সে-রকমই মনে হচ্ছে।
মুহিব বলল, জি।
চাকরিতে জয়েনিং, তাহলে এখানে এসেছিস কেন? প্রথম দিনেই অফিসে দেরি করে যাবি? আমাদের কথা এখন একেবারেই মাথায় রাখবি না। মন দিয়ে চাকরি করবি।
মুহিব এগিয়ে এসে সফিকের পা ছুঁয়ে সালাম করল। সফিক বিরক্ত গলায় বলল, এইসব কী? নিজের বাবা মাকে সালাম করেছিস?
মাকে করেছি।
একটা বেবিটেক্সি নিয়ে এক্ষুণি তোর বাবার কাছে যা। তাঁকে সালাম কর। আমি একটা থার্ড গ্রেড ড্রাগ এডিক্ট, মাতাল। আমাকে তুই সালাম করছিস কী মনে করে? তোর কি ব্রেইন ডিফেক্ট হয়ে গেছে? হা করে দাঁড়িয়ে আছিস কেন? বেবিটেক্সি নিয়ে বাবার কাছে চলে যা। বেবিটেক্সি ভাড়া আছে?
আছে।
সত্যি আছে তো?
জি আছে। সফিক ভাই, হারুন কোথায়?
আরে ঐ গাধার কথা বলিস না। সে বাথরুম করতে নিজের বাড়িতে গেছে। তার না-কি অপরিচিত জায়গায় বাথরুম হয় না। এইসব ইডিয়টদের নিয়ে আমার চলতে হয়। আত্মাহুতি যে দেবে সে আরাম করে হাগু করার জন্যে বাসায় চলে গেছে। আমি একা দোকান খুলে বসে আছি। একটার পর একটা যন্ত্রণা পার করছি। অসহ্য লাগছে। কেরোসিনের টিন কিনেছিলাম— হাপিশ।
হাপিশ মানে?
দশ মিনিটের জন্যে সিগারেট কিনতে গিয়েছি। টিনটা তাঁবুর ভিতর রেখে গেছি, ফিরে এসে দেখি নাই। আবার একটা কেরোসিনের টিন কিনতে হবে। কেরোসিনের টিন বড় একটা পাবলিসিটি। সবাই হারুনকে যতক্ষণ দেখে তার চেয়ে বেশি দেখে কেরোসিনের টিনটাকে। হারুনের যে কটা ছবি পত্রিকায় ছাপা হয়েছে সবকটা ছবির বেস-এ কেরোসিনের টিনটা আছে।
লোকজন কেমন আসছে?
ভালোই আসছে। Response খুবই ভালো। ফিল্ম লাইন থেকে নায়ক রিয়াজ এসেছিলেন। চারদিকে ভিড় হয়ে গেল। হারুনের সঙ্গে পাঁচ মিনিটের মতো বসেছিলেন। এত বড় স্টার, কিন্তু কোনো অহঙ্কার দেখলাম না। আমাকে বললেন, দেখি ভাই একটা সিগারেট দিন তো। আরে এমনই আমার কপাল, সিগারেট দিতে পারলাম না।
কেন?
প্যাকেটটা খুলে দেখি প্যাকেট খালি। লজ্জায় আমার মাথা কাটা গেছে। রিয়াজ সাহেব নিজেই অ্যাসিসটেন্ট পাঠিয়ে সিগারেট আনালেন। নিজে একটা খেলেন। সবাইকে দিলেন। যাবার সময় প্যাকেটটা আমার হাতে দিয়ে গেলেন। নিখুঁত ভদ্রলোক। তুই দেখি হা করে গল্পই শুনছিস। বিদেয় হ। ভালো কথা। যূথী নামের মেয়েটার সঙ্গে কি তোর যোগাযোগ হয়েছে?
না।
ঐ মেয়ে প্রেসক্লাবের সামনে গতকাল তিনবার এসেছে। তোর সঙ্গে কথা বলতে চায়। খুব নাকি জরুরি। আমি বলে দিয়েছি মুহিব রাজশাহী গেছে তার এক ভাগ্নির বিয়েতে। চার পাঁচ দিন পরে ফিরবে। এই বলে কাটান দিয়েছি। যাই হোক, যূথীর ব্যাপার নিয়ে তোক চিন্তা করতে হবে না। তুই তোর কাজ কর। এখন মাথার ভেতর যূথী-যূথী ঢোকালে সমস্যা আছে।
শামসুদ্দিন সাহেবের বাড়ির সব দরজা-জানালা খোলা। বাড়ির উঠানে টুল পাতা। টুলে মাথা কামানো গুণ্ডা টাইপ চেহারার এক লোক বসে আছে। মুহিবের দিকে তাকিয়ে সেই লোক বলল, কারে চান?
মুহিব বলল, এই বাড়িতে যিনি থাকতেন তাকে চাচ্ছি।
আপনি তার কে হন— কুটুম্ব?
আমি উনার ছেলে।
যান, ভিতরে যান।
আপনি কে?