জি।
তোমার বিষয়ে একটা অপ্রিয় সিদ্ধান্ত আমরা নিয়েছি। বাধ্য হয়ে নিতে হয়েছে। শেকসপিয়রের কথায় বলি—Thave to be cruel only to be kind.
কী সিদ্ধান্ত?
তুমি এই বাড়িতে আর বাস করবে না। অন্য কোথাও থাকবে। হোটেলে, কিংবা কোনো বন্ধুর বাড়িতে কিংবা রেলস্টেশনে।
জি আচ্ছা।
জানতে চাচ্ছ না কেন?
বুঝতে পারছি। মনে হচ্ছে চুরি সংক্রান্ত কিছু। বড় ভাইজানের টাকাটা বোধহয় আমার ঘরে পাওয়া গেছে।
তৌফিকুর রহমান ইজিচেয়ারে সজা হয়ে বসতে বসতে বিস্মিত গলায় বললেন, আমি অবাক হচ্ছি, তুমি খুবই স্বাভাবিক আচরণ করছ। তোমার মধ্যে অপরাধবোধ গ্লানিবোধ কিছুই দেখছি না।
মুহিব বলল, একটু আগে গোসল করেছি তো চাচা! আমাকে ফ্রেশ লাগছে। চেহারায় এই জন্যেই গ্লানিবোধ অপরাধবোেধ এইসব জিনিসের ছাপ পড়ছে না।
তোমার সঙ্গে আমার কথা শেষ, তুমি এখন যাও। যদি সম্ভব হয় তুমি তোমার মায়ের সঙ্গে দেখা করবে। সেই বেচারি মনে খুব কষ্ট পেয়েছে। কান্নাকাটি করছিল। তোমার মুখ দেখতে হবে এই ভয়ে সে বাড়ি ছেড়েই চলে গেছে।
মুহিব উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে বলল, আপনি যে ছাগলের লাদির মতো বড়িগুলো খাওয়াচ্ছিলেন সেগুলি কি খেয়েই যাব না খাওয়া বন্ধ করে দেব?
তৌফিকুর রহমান কোনো জবাব দিলেন না। মুখের সামনে খবরের কাগজ ধরলেন।
রাত দশটার দিকে মুহিব একটা স্যুটকেস এবং একটা হ্যান্ডব্যাগ নিয়ে খায়রুল মিয়ার ফ্ল্যাট বাড়িতে উঠে এলো। খায়রুল মিয়ার আনন্দের সীমা রইল না। তার ভাবভঙ্গি দেখে মনে হচ্ছে সে কী করবে ভেবে উঠতে পারছে না।
সে তার হাঁসের মতো ফ্যাসফ্যাসে গলায় বলল, ভাইজান এখন থেকে এই বাড়ি আপনার বাড়ি। বুঝেছেন, কী বলেছি? আপনার বাড়ি। যদি মনে করেন আমাকে লাথি দিয়ে বের করে দিবেন— কোনো অসুবিধা নাই। আমার পাছায় লাত্থি দিবেন।
মুহিব বলল, ঠিক আছে প্রয়োজনে দেব। রাতে খানা কী খাবেন, বলেন।
রাতে কিছু খাব না। শরীর ভালো লাগছে না। কাল সকালে আমি চাকরিতে জয়েন করব। আমার টাই দরকার। টাই জোগাড় করে দেবেন। পারবেন?
আমি পারব না, কী বলেন আপনি? আপনি বলেন কী! আপনার টাই কয়টা দরকার? কী কালার?
মুহিব জবাব দিল না। খায়রুল আগ্রহের সঙ্গে বলল, ভাইজান আপনি চাকরি পেয়েছেন? মুহিব জবাব দিল না।
খায়রুলের সকল প্রশ্নের জবাব দিতে তার ভালো লাগে না। কোনো এক বিচিত্র কারণে ক্লান্তিতে তার চোখ বন্ধ হয়ে আসছে। তাকে প্রেসক্লাবের সামনে অবশ্যই যেতে হবে। হারুনের অবস্থাটা কী দেখে আসা দরকার।
মনোয়ারা অবাক হয়ে তাকিয়ে আছেন
মনোয়ারা অবাক হয়ে তাকিয়ে আছেন। নিজের ছেলেকে তাঁর অচেনা লাগছে। ফিটফাট সাহেব। সাদা প্যান্টের উপর হালকা সবুজ রঙের ফুলহাতা শার্ট। গলায় টাই ঝুলছে। টাইটার রঙও সবুজ। সবুজের উপর সবুজ দেখতে এত ভালো লাগছে। টাইপরা অবস্থায় মুহিবকে তিনি আগে দেখেন নি। মনোেয়ারা অবাক হয়ে বললেন, ব্যাপার কী রে?
মুহিব বলল, তোমাকে সালাম করতে এসেছি।
সালাম কী জন্যে?
চাকরিতে জয়েন করব। আজই জয়েন করার কথা।
মনোয়ারা অবিশ্বাসী গলায় বললেন, সত্যি চাকরি পেয়েছিস? বেতন কত?
মুহিব নিচু গলায় বলল, পনেরো-বিশ হাজার হবে। মাস শেষ হোক। বেতনটা হাতে পাই তারপর বোঝা যাবে।
আমার সঙ্গে ফাজলামি করছিস না তো?
না।
মুহিব নিচু হয়ে মার পা ছুঁয়ে সালাম করল।
মনোয়ারা সন্দেহ মিশ্রিত গলায় বড় মেয়েকে ডাকলেন, বুলু, শুনে যা। মুহিব বলছে সে চাকরি পেয়েছে। স্যুট-টাই পরে সাহেব সেজে এসেছে।
বুলু রান্নাঘরে রান্না করছিল। সেখান থেকে গলা উঁচিয়ে ডাকল, মুহিব, শুনে যা এদিকে।
মুহিব রান্নাঘরের দরজার পাশে দাঁড়িয়ে উঁকি দিল। ভেতরে ঢুকল না। রান্নাঘর ধোয়ায় অন্ধকার। গরম এবং ধোঁয়ার মধ্যে ঢোকার কোনো অর্থ হয় না।
বুলু বলল, তুই চাকরি পেয়েছিস?
মুহিব বলল, হুঁ। জয়েন করতে যাচ্ছি, আজই জয়েনিং ডেট।
চাকরির কথা আগে কোনো দিন শুনলাম না। আজ একেবারে জয়েনিং ডেট। এগুলি কেন করছিস, মাকে খুশি করার জন্য? যাতে মা মনে করে আমার ছেলে চোর না। চাকরি-বাকরি করে। অফিসার সেজে অফিসে যায়। এতদিন শুনেছি চোরের মার বড় গলা। এখন দেখি চোরের তার চেয়েও বড় গলা।
মুহিব বলল, চুরির ব্যাপারটা শুনেছ?
বুলু বলল, কেন শুনব না? তুই কি ভেবেছিলি চুরির ব্যাপার নিয়ে কেউ আলোচনা করবে না? আমি তো চিন্তাই করতে পারি নি কেউ তার ভাইয়ের টাকা চুরি করতে পারে।
অন্যের টাকা চুরি করার চেয়ে ভাইয়ের টাকা চুরি করা ভালো না? টাকা সংসারেই থাকল। বাইরে গেল না।
বুলু রাগী গলায় বলল, চুরির পক্ষে যুক্তি দেয়াও শুরু করেছিস? লজ্জাও করছে না? লায়েক তো ভালোই হয়েছিস। আমাকে এখন যদি কেউ জিজ্ঞেস করে, আপনার ভাইরা কী করে? আমি কী বলব? এক ভাই ব্যাংকের এজিএম, আরেক ভাই প্রফেসর, সবচেয়ে ছোটটা চোর। শ্বশুরবাড়িতে আমার মুখ বলে কিছু আছে? নিজের বাবা সম্পর্কেও কাউকে কিছু বলতে পারি না। ঘেন্না লাগে। ঐ দিন দেখি বাসার সামনে হাঁটাহাঁটি করছে। সঙ্গে সঙ্গে জানালা বন্ধ করে দিয়েছি।
বাবা তোমার বাসার সামনে হাঁটাহাঁটি করে?
মাসে এক দুইবার করে। লজ্জাহীন মানুষ হলে যা হয়।
মুহিব বলল, আপা যাই।
বুলু বলল, চা-টা কিছু খাবি? নাশতা করে এসেছিস?
মুহিব বলল, চা খাব না। নাশতাও করে এসেছি।
এখন যাচ্ছিস কোথায় ঠিক করে বল তো?