মুহিব ঝিম ধরে চেয়ারে বসে আছে। বাথরুম থেকে কোনো শব্দ আসছে। মুহিবের ঘুমে চোখ জড়িয়ে আসছে। সোফাটাকে খুবই আরামদায়ক মনে হচ্ছে। মনে হচ্ছে, এই সোফা তৈরি হয়েছে ঘুমুবার জন্যে। সে চেষ্টা করছে। জেগে থাকার জন্যে। কিন্তু জেগে থাকতে পারছে না। চোখের পাতা ভারী।
তার ঘুম ভাঙল। চায়ের কাপে চামচের শব্দ শুনে। চোখ মেলে দেখে নোরা কার্পেটে বসে আছে। তার হাতে কফির কাপ। কফির পোড়া পোড়া গন্ধে ঘর ম ম করছে।
নোরা বলল, তুমি কতক্ষণ ঘুমিয়েছ জানো?
মুহিব বলল, না।
আমি বাথরুম থেকে বের হয়ে দেখি তুমি ঘুমাচ্ছ। কাজেই তোমাকে আর জাগাই নি। তুমি তেতাল্লিশ মিনিট ধরে ঘুমাচ্ছ। গভীর ঘুম।
সরি।
সরি কেন? সরি বলার মতো কোনো কাণ্ড তুমি কর নি। তবে আমার পরিকল্পনা নষ্ট করে দিয়েছ। তোমার উপর আজ কোনো হিপনোসিস প্রক্রিয়া চালানো যাবে না। যে মানুষ গভীর ঘুম থেকে জেগে উঠেছে তাকে হিপনোটাইজ করা যায় না। আরেক দিন হাতে সময় নিয়ে চলে এসো।
কবে আসব?
যে-কোনোদিন। সন্ধ্যার পরে এসো।
আজ সন্ধ্যায় আসব?
আজ না। আজ আমি বাড়িতে থাকব না।
মুহিব মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে আছে। এইমাত্র গোসল করার কারণেই হোক বা যে-কোনো কারণেই হোক কী সুন্দর যে মেয়েটাকে লাগছে! হালকা গোলাপি রঙের একটা টাওয়েল দিয়ে নোরা মাথার চুল ঢেকে রেখেছে। টাওয়েলটাকে
নোরা কফির কাপে চুমুক দিতে দিতে বলল, তোমার ভাব-ভঙ্গি দেখে মনে হচ্ছে তুমি আবারও ঘুমিয়ে পড়ছ। তোমার চোখ ছোট হয়ে আসছে। দয়া করে এখন বিদেয় হও। গাড়ি নিয়ে যাও। তুমি যেখানে যেতে চাও গাড়ি তোমাকে নিয়ে যাবে।
সত্যি সত্যি মুহিবের ঘুম পাচ্ছে। তার কোথাও যেতে ইচ্ছা করছে না। সোফাতে হেলান দিয়ে এই ঘরেই ঘুমিয়ে পড়তে ইচ্ছা করছে। মুহিব অনেক কষ্টে উঠে দাঁড়াল। নোরা বলল, তোমার যে বন্ধু Death Wish করছে আমি আজ দিনের মধ্যে কোনো এক সময় তাকে গিয়ে দেখে আসব।
মুহিব বলল, আমি কি তোমার গাড়িটা আজ সারাদিন আমার সঙ্গে রাখতে পারি?
পার। আমি ড্রাইভারকে বলে দিচ্ছি।
মুহিব মুগ্ধ চোখে নোরার দিকে তাকিয়ে আছে। যে লাল কার্পেটের উপর নোরা বসে আছে সেই কার্পেটটাকেও মুহিবের এখন নোরার শরীরের অংশ বলে মনে হচ্ছে। এরকম হচ্ছে কেন?
হারুন কুণ্ডুলি পাকিয়ে শুয়ে আছে। বাঁশের আগা থেকে ছাতা নামিয়ে তার মুখের উপর ধরা হয়েছে রোদ আটকাবার জন্যে। চাওয়ালা জতু মিয়া হারুনের মাথার চুলে বিলি করে দিচ্ছে। হারুনের পায়ের কাছে কেরোসিনের টিন এবং টিনের পাশে পিরিচে চারটা দেয়াশলাই। কেরোসিনের টিন এবং দেয়াশলাইয়ের মাহাত্ম কেউ বুঝতে পারছে না, কারণ পোস্টার এখনো লাগানো হয় নি। তারপরেও পথচারীদের কেউ কেউ কৌতূহলী হয়ে তাকে দেখছে। হারুনের কাছ থেকে দশ-বার গজ দূরে গাছের ছায়ায় সফিক একা বসে সিগারেট টানছে। তার মুখ দেখেই বোঝা যাচ্ছে মেজাজ খুব খারাপ।
মুহিব সফিকের দিকে এগিয়ে গেল। সফিক বলল, ওদের কাণ্ডজ্ঞান দেখেছিস আড়াইটা বাজে কারো কোনো খোঁজ নেই! খাওয়া-দাওয়া তো করতে হবে।
মুহিব বলল, এখনো খান নি?
সফিক রাগী গলায় বলল, খাব কীভাবে? ফাইভস্টার থেকে খাওয়া আসবে। পকেটে শেষ সম্বল সাইট টাকা ছিল— এক প্যাকেট বেনসন কিনে ফেলেছি। তুই খেয়েছিস?
মুহিব বলল, না।
সফিকের রাগ সঙ্গে সঙ্গে পড়ে গেল।
মুহিব বলল, আমি আপনাদের জন্যে খাবার নিয়ে আসি।
কোত্থেকে আনবি?
আমার চেনা একটা রেস্টুরেন্ট আছে।
বাকি দেয়?
হ্যাঁ, দেয়।
তাহলে এক কাজ কর, আট-দশ জনের মতো খাবার নিয়ে আয়। পরে দেখা যাবে সবাই এক এক করে উদয় হচ্ছে কেউ খেয়ে আসে নি। হারুনের জন্যে এক বাটি স্যুপ আনতে পারবি? ওর তো জ্বর এসেছে। ভালো জ্বর। একটা থার্মোমিটারও নিয়ে আসিস। সঙ্গে ভাংতি টাকা-পয়সা আছে?
আছে।
দুটাকার বাদাম কিনে দিয়ে যা। বাদাম খেয়ে আগে ক্ষিধাটা নষ্ট করি। নাড়িভুড়ি হজম হয়ে গেছে। এখন পেটের চামড়া হজম হওয়া শুরু হয়েছে।
মুহিব গরম সিঙাড়া এবং ডালপুরি কিনে আনল। সঙ্গে তেঁতুলের চাটনি। পেঁয়াজ কাটা কাঁচামরিচ। সিঙাড়া এত গরম যে জিভ পুড়ে যাওয়ার মতো অবস্থা। সফিক আনন্দিত গলায় বলল, এত কিছু আনার তো দরকার ছিল না। চট করে কিছু মুখে দিয়ে কাজে বের হয়ে যা। এক সেকেন্ডও সময় নষ্ট করা যাবে না। বিভিন্ন জায়গায় যে যাবি রিকশা ভাড়া আছে?
আমার সঙ্গে গাড়ি আছে।
গাড়ি আছে মানে? কার গাড়ি?
গান করেন যে নোরা উনার গাড়ি।
বলিস কী! গাড়ি ম্যানেজ করলি কীভাবে?
হারুনের ব্যাপারটা বললাম। বিভিন্ন জায়গায় যেতে হবে। এইসব শুনে…
সফিক আনন্দিত গলায় বলল, ভালো ম্যানেজ করেছিস তো। উনি আসবেন না?
বলেছেন আসবেন।
কবে আসবেন?
আজই আসার কথা।
বলিস কী! পাবলিক অপিনিয়ন তো দেখি এখনই তৈরি হওয়া শুরু হয়েছে। নোরার মতো গায়িকার দেখতে আসা সহজ ব্যাপার না। একজন স্টিল ফটোগ্রাফার সার্বক্ষণিকভাবে থাকা দরকার, সেলিব্রিটি কেউ আসল, ঝপাঝপ ছবি। তোর বাসায় ক্যামেরা আছে?
বড় ভাইজানের আছে। দিবে না।
চেষ্টা করতে তো ক্ষতি নেই। চেষ্টা না করেই যদি বলে ফেলিস দিবে না তাহলে হবে কীভাবে? সব কাজ বাদ দিয়ে বাসায় যা, তোর ভাইকে ভজিয়ে ভাজিয়ে ক্যামেরা নিয়ে চলে আয়। নোরা ম্যাডাম যদি সত্যি আসেন তাহলে অবশ্যই ছবি তুলতে হবে। উনার সঙ্গে তার পরিচয় কেমন?
সামান্য পরিচয়।