নোরা বাড়িতে আছে। ঘুম থেকে উঠেছে অনেক আগে। সাজসজ্জা দেখে মনে হচ্ছে এক্ষুণি বের হবে। মুহিব কিছু বলার আগেই নোরা বলল, তুমি হাতে সময় নিয়ে এসেছ তো?
মুহিব বলল, হ্যাঁ।
মিনিমাম দুঘণ্টার জন্যে তুমি কিন্তু আটকা পড়ে গেলে। তুমি খুবই ভুল সময়ে এসেছ।
মুহিব কথার পিঠে সুন্দর কোনো কথা বলার চেষ্টা করল। কোনো কিছুই মনে আসছে না। এদিকে সফিকের কোনো তুলনা নেই। কথার পিঠে কথা সফিকের মতো সুন্দর করে কেউ বলতে পারে না।
চা খাবে না কফি খাবে?
চা।
নোরা বলল, চা না কফি খাও। কারণ আমার কফি খেতে ইচ্ছা করছে।
আচ্ছা কফি দাও।
আমার ঘরে চলে এসো। ঘর খুবই এলোমেলো। তাতে নিশ্চয়ই তোমার সমস্যা হবে না। আমি মাঝে মাঝে ঘর খুব গুছিয়ে রাখি। মাঝে মাঝে ইচ্ছা করে ঘর এলোমেলো করে রাখি। তুমি এসেছ এলোমলো সময়ে।
মুহিব মনে মনে দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলল। তুমি এসেছ এলোমেলো সময়ে। কী সুন্দর কথা! এই কথার পিঠে যদি এরচেও সুন্দর কোনো কথা বলা যেত! যখন মুহিব মোটামুটি ইন্টারেস্টিং একটা সেনটেন্স মনে মনে গুছিয়ে এনেছে তখনই নোরা বলল, তুমি কি কোনো কাজে এসেছ না সৌজন্য সাক্ষাৎ?
কাজে এসেছি। তুমি কি বাংলাদেশের গায়ক-গায়িকাদের চেন?
চিনব না কেন! অবশ্যই চিনি।
তাদের সঙ্গে কি তোমার খাতির আছে? তুমি কোনো কথা বললে কি তারা রাখবে?
রাখবে না। কারণ আমি তাদের কাউকেই সহ্য করতে পারি না। ওরাও আমাকে সহ্য করতে পারে না। ওদের ধারণা আমি গান গাইতে পারি না। আমার গলায় সুর নেই। অকারণেই আমাকে নিয়ে মাতামাতি হয়। আর আমার ধারণা, ওরা কেউ ঠিকমতো গাইতে পারে না। ওদের গলায় সবই আছে, মমতা নেই। তোমার কি গায়ক-গায়িকা দরকার? কোনো ফাংশনে গান গাইতে হবে?
তা না।
অল্প কথায় গুছিয়ে বলতে পারলে বলো। আমি তোমাকে আমার ঘরে বসিয়ে রেখে গোসলে ঢুকব। আমার গোসল সারতে এক ঘণ্টা লাগে। এক ঘণ্টা পরে তোমাকে নিয়ে একটা এক্সপেরিমেন্ট করব। দুঘণ্টা শেষ। তুমি তোমার কাজে চলে যেতে পারবে।
মুহিব হারুনের ব্যাপারটা বলল। একটু বাড়িয়েই বলল— যেমন হারুন নিজেই এক টিন কেরোসিন কিনে এনেছে। আত্মীয়স্বজন বন্ধুবান্ধব সবার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে এখন মৃত্যুর প্রতীক্ষা করছে।
নোরা বলল, তোমার ঐ বন্ধু তো মানসিকভাবে অসুস্থ। গায়ক-গায়িকা জোগাড় না করে তাকে বরং কোনো মানসিক ডাক্তার দেখাও। সবচে ভালো কী জান কোনো হিপনোটিস্ট দিয়ে তাকে হিপনোটাইজ করে সাজেশান দেয়া। হিপনোটাইজ করাটা যদি আমি ভালোমতো শিখতে পারতাম তাহলে আমি নিজেই করতাম। আমি অনেককে নিয়ে চেষ্টা করেছি। আমার সাকসেস রেন্ট
অনলি টুয়েন্টি পারসেন্ট। তুমি কি কাউকে হিপনোটাইজড হতে দেখেছ?
না।
খুবই ইন্টারেস্টিং ব্যাপার। তমাকে নিয়ে একটা এক্সপেরিমেন্ট করব বলছিলাম না? হিপনোসিস নিয়ে এক্সপেরিমেন্ট। তোমার আপত্তি নেই তো?
না।
রিলাক্সড হয়ে বসো। কোনোরকম টেনশন করবে না। টেনশন করার কিছু নেই।
মুহিব রিলাক্সড হয়েই বসে আছে। সে যে ঘরে বসে আছে সেটা নোরার শোবার ঘর। নোরার খুবই ব্যক্তিগত একটা জায়গা। সে বসেছে হালকা সবুজ রঙের নিচু একটা সোফায়। সোফাটা নোরার বিছানার সঙ্গে লাগানো। বিছানার চাদর এবং সোফা মনে হয় একই কাপড় দিয়ে বানানো। ঘরের পর্দাগুলির রঙও সবুজ। ধবধবে শাদা মার্বেলের মেঝে। মাঝখানে গাঢ় লাল রঙের কার্পেট। ঘরটায় রঙ ঝলমল করছে অথচ কোনো রঙ চোখে লাগছে না।
নোরা বাথরুমে ঢুকে গেছে। শোবার ঘরের সঙ্গে লাগানো বাথরুম। মুহিব যেখানে বসেছে সেখান থেকে বাথরুমের দরজা দেখা যায়। দরজার দিকে তাকিয়ে থাকতে মুহিবের লজ্জা লাগছে বলে সে অন্যদিকে তাকিয়ে আছে। শাওয়ার দিয়ে পানি ঝরার শব্দ কানে আসছে। সেই শব্দের সঙ্গে গলা মিলিয়ে মাঝে মাঝেই নোরা ঝিনিনি ঝিনিনি নি…র মতো সুর করছে। শুনতে এত অদ্ভুত লাগে! বাথরুমের ভেতর থেকে সে মাঝে মাঝে মুহিবের সঙ্গে কথা বলছে। কথাগুলি শোনাচ্ছে অদ্ভুত। মনে হচ্ছে অনেক দূর থেকে অন্য কেউ কথা বলছে…
একা একা বোর হচ্ছ?
না।
আমার ঘরে অনেক ম্যাগাজিন আছে। যে-কোনো একটা ম্যাগাজিন নিয়ে পাতা উল্টাও, সময় কেটে যাবে।
দরকার নেই।
সময় কাটাবার খুব ভালো বুদ্ধি কী জানো?
না।
সময় কাটাবার সবচে ভালো বুদ্ধি মানুষকে যে প্রাণীটা দিয়েছে তার নাম গরু, The cow. জানো ব্যাপারটা?
না।
গরু কী করে? জাবর কাটে। সময় কাটাবার জন্যে মানুষ এই কাজটা করতে পারে। কাজটা একটু অন্যভাবে করতে হবে। স্মৃতির জাবর কাটতে হবে। কোনো একটা ইন্টারেস্টিং স্মৃতি নিয়ে জাবর কাটা। আমি এই কাজটা প্রায়ই করি। এখন আমি কী করছি অনুমান করতে পার?
না।
বাথটাব ভর্তি পানি। আমি গলা ড়ুবিয়ে পানিতে শুয়ে আছি। আমার হাতে একটা জ্বলন্ত সিগারেট।
তুমি কি এখন নিয়মিত সিগারেট খাচ্ছ?
তা খাচ্ছি। দিনে এক প্যাকেটের বেশি শেষ হচ্ছে। তবে খুব শিগগিরই ছেড়ে দিব। আমি কোনো কিছুই বেশিদিন ধরে রাখি না। বেশির ভাগ মানুষের স্বভাব পুরনো জিনিস ধরে রাখা। মানুষ কিছুই ফেলতে পারে না। এই জন্যে মানুষকে বলা হয় The collector. আমি অনেকক্ষণ কথা বললাম। এখন কথা বন্ধ। আমি মেডিটেশনে যাচ্ছি। গোসল করতে আমার দেরি হয় এই কারণে। আমি আধঘণ্টার মতো মেডিটেশন করি। পানিতে শবাসন হয়ে শুয়ে থাকি। মাথা থেকে সব চিন্তা-ভাবনা দূর করে দেই।