তৈয়ব বলল, না। এতে ব্যাপারটা হাস্যকর হয়ে যাবে। মনে হবে আমরা ড্রামা তৈরির চেষ্টা করছি।
সফিক বলল, ড্রামা তো করতেই হবে। পাবলিসিটির জন্য ড্রামা দরকার। যারা হারুনকে দেখতে আসবে তারা ধাক্কার মতো খাবে। যে আগুন দিয়ে নিজেকে পুড়াতে চাচ্ছে সে শুধু মুখের কথা বলছে না, একটিন কেরোসিন পর্যন্ত কিনে এনেছে …
আলোচনা হৈচৈ তর্ক বিতর্ক। কোনো কিছুতেই হারুনের মন নেই। সে মোটামুটি মূর্তির মতোই বসে আছে। তাকে সিগারেট দেয়া হয়েছিল। সে বলেছে না।
মহসিন বলেছে, সিগারেট খেতে সমস্যা কোথায়? তুই তো অনশন করছিস না। আগুন দিয়ে নিজেকে পুড়িয়ে কয়লা বানিয়ে ফেলবি। সেই ঘটনা যখন ঘটার কথা তখন ঘটবে। ঘটনা ঘটার আগে তুই তোর ইচ্ছামতো খাওয়া দাওয়া করবি। চা দিয়ে একটা সিগারেট খা।
না।
তুই আমাদের সঙ্গে রেগে রেগে কথা বলছিস কেন? আমরা কী করলাম?
হারুন চুপ করে আছে। মহসিন বলল, তোর কি জ্বর না-কি? চোখ লাল।
তারও কোনো জবাব নেই।
হারুনের ব্যাপারটা বোঝা যাচ্ছে না। এমন কী ঘটনা ঘটল যে গায়ে আগুন জ্বালিয়ে দিতে হবে? কোনো মেয়ের সঙ্গে প্রেম-ফ্রেম থাকলে চিত্ত তরল থাকে। হঠাৎ হঠাৎ উদ্ভট কিছু করতে ইচ্ছে করে। হারুনের এরকম কিছুও নেই। বিয়েও করে নি যে বেকার স্বামীকে নিয়ে স্ত্রী ঘ্যানঘ্যান প্যানপ্যান করছে। তার সঙ্গে যুক্ত হচ্ছে শ্বশুরবাড়ির জ্ঞানী লোকজন। বেকারদের দলে হারুনের অবস্থা ভালো। সে তার নিজের বাড়িতে থাকে। তার আলাদা ঘর আছে। হারুনের বাবা রিটায়ার্ড এসপি। মাই ডিয়ার টাইপ মানুষ। হারুনের কোনো বন্ধু-বান্ধব বাড়িতে উপস্থিত হলে তিনি চোখ সরু করে তাকান না। বরং হাসি মুখে বলেন— এসো এসো। বলো দেখি কী খবর। ইয়াং ম্যানদের দেখলেই শরীরে কেমন যেন ইয়াং ভাব চলে আসে। বৃদ্ধদের এই কারণেই সবচে বেশি সময় কাটানো উচিত তরুণদের সঙ্গে। সেটা কখনো হয়ে উঠে না। তরুণরা বৃদ্ধ পছন্দ করে না।
বেকার তরুণদের মধ্যে হারুন হয়তোবা অতি অল্প কিছু ভাগ্যবানদের একজন যার জন্মদিন পালন করা হয়। আত্মীয়স্বজনরা বাড়িতে গিজগিজ করতে থাকে। বাইরের বাবুর্চি এসে মোরগ-পোলাও রান্না করে। হারুনের বাবা অত্যন্ত আনন্দিত ভঙ্গিতে ইস্ত্রি করা পাঞ্জাবি গায়ে দিয়ে ঘোরাঘুরি করেন। সুযোগ পেলেই ছোটবেলায় হারুন কেমন ছিল, কী করত খুবই আগ্রহের সঙ্গে সেই গল্প করেন— হারুনকে নিয়ে আমি একটা ছড়া বানিয়েছিলাম। ছড়াটা বললেই ক্ষেপে যেত। কান্নাকাটি। ভাত খাওয়া বন্ধ টাইপ ক্ষেপা। অথচ খুবই নির্দোষ ছড়া—
হারুন।
ঘাড় ধরে মারুন।
চড় থাপ্পর কিল ও ঘুসি
মার খেলেই হারুন খুশি।
প্রতি জন্মদিনে এই ছড়াটা আমি একবার করে বলি এবং তার রি-অ্যাকশন লক্ষ করি। আট বছর পর্যন্ত সে কাঁদত। আট বছর থেকে বারো বছর পর্যন্ত রেগে যেত। আমাকে মারতে আসত। বারোর পর থেকে বিরক্ত হওয়া শুরু করেছে।
এ ধরনের পারিবারিক অবস্থার একটি ছেলে হঠাৎ একদিন বলবে গায়ে আগুন জ্বালিয়ে দিব–তা হয় না। কোথাও কোনো একটা সমস্যা হয়েছে। সমস্যাটা বোঝা যাচ্ছে না।
মুহিবের উপর দায়িত্ব পড়েছে— শো-বিজনেসের লোকজনের সঙ্গে যোগাযোগ করা। তারা যেন একবার এসে এক মিনিটের জন্যে হলেও হারুনকে দেখে যান। বিবৃতি দেন আমরা পাশে আছি। হারুনের জন্যে আমাদের সহানুভূতি আছে। মুহিবের হাতে বিশাল এক তালিকা ধরিয়ে দেয়া হয়েছে। সেখানে ফিল্মের লোক আছে, নাটকের লোক আছে, গানের শিল্পীরা আছে। এদের মধ্যে মুহিব চেনে মাত্র চারজনকে। নোরাকে চেনে। সে গায়িকা এবং তার যথেষ্টই নামডাক আছে। নোরাকে বুঝিয়ে বললে সে শুধু যে আসবে তা না, হারুনের পাশে সারাদিন বসে থাকতে বললে সারাদিন বসে থাকবে।
নোরা যেহেতু গান করে সে নিশ্চয়ই অন্য গানের শিল্পীদেরও চেনে। তার মাধ্যমে অন্যদের কাছে যাওয়া। পাখি দিয়ে পাখি শিকার।
নাটকের লোকজনদের মধ্যে জাহিদ হাসানের এক ফুপাতো ভাইয়ের সঙ্গে পরিচয় আছে। তাকে নিয়ে বাসায় যাওয়া যাবে। ভাগ্য ভালো হলে জাহিদ হাসানের স্ত্রী মৌ বাসায় থাকবেন। দুজনকেই বলা যাবে। মেয়েদের মন নরম টাইপ হয়, মৌ ভাবি হয়তো বা রাজি হয়ে যাবেন কিছুক্ষণের জন্যে আসতে। নাটকের আরেকজন শিল্পীর বাসায় মুহিব একবার গেছে। শীলা আহমেদ। তাকে বললে সে অবশ্যই রাজি হবে। তবে মেয়েটা এখন নাটক ছেড়ে দিয়েছে। নাটক ছেড়ে দিলেও লোকজন তাকে চিনে। এখন নিশ্চয়ই বিভিন্ন অনুষ্ঠানে নিয়ে যাবার জন্যে লোকজন তার পেছনে লেগে থাকে না। সেখানে হঠাৎ একজন কেউ উপস্থিত হলে খুশিতেই রাজি হয়ে যাবার কথা।
একটা গাড়ির ব্যবস্থা রাখতে হবে। কেউ রাজি হলো, সঙ্গে সঙ্গে গাড়ি গিয়ে তাকে নিয়ে এলো। নোরাদের তিনটা গাড়ি। দুজন ড্রাইভার। একটা গাড়ি কখনো ব্যবহারই করা হয় না। গাড়ি চাইলে নোরা কি দেবে? দেয়ার তো কথা।
মুহিব নোরার বাড়ির দিকে রওনা হলো। এগারোটা বাজে। নোরাকে বাড়িতে পাওয়ার সম্ভাবনা একশ দশ ভাগ। নোরা রাত তিনটা সাড়ে তিনটার দিকে ঘুমুতে যায়। এগারোটার আগে সে ঘুম থেকেই উঠে না। ইউনিভার্সিটি খোলা থাকলেও না। সকালের সব ক্লাস তার মিস যায়। এখন ইউনিভার্সিটি বন্ধ। এগারোটার আগে ঘুম থেকে উঠার তার প্রশ্নই আসে না। নোরার বাবা কি বাসায় আছেন? ভদ্রলোকের পায়জামা-পাঞ্জাবিটা নিয়ে এলে হতো। ধোপাখানায় দিয়ে ইস্ত্রি করে রাখা উচিত ছিল।