না।
ফট করে না বলিস না। চিন্তা করে বল। ভালোমতো চিন্তা করলে দেখবি কেউ না কেউ বের হয়ে পড়েছে। এক হাজার টাকা ম্যানেজ করে চলে আয়। এক হাজার টাকা হলো মিনিমাম। যত বেশি হয় তত ভালো। কথা বলে সময় নষ্ট করিস না। দৌড় দিয়ে ঘর থেকে বের হ।
টাকার জন্যে মুহিব গেল মনোয়ারার কাছে। তিনি অবাক হয়ে বললেন, তোর কত টাকা লাগবে বললি?
পাঁচ হাজার।
এত টাকা দিয়ে তুই কী করবি?
আমার এক বন্ধুর চিকিৎসার জন্যে দরকার। সে মারা যাচ্ছে।
তোর কি মাথাটাথা খারাপ হয়ে গেছে? বন্ধুর চিকিৎসার জন্যে পাঁচ হাজার টাকা? টাকা সস্তা হয়ে গেছে!
মা প্লিজ ব্যবস্থা কর। এখন ধার হিসাবে নিচ্ছি। পাই পয়সা হিসাব করে টাকা ফেরত দেব।
আমি টাকা পাব কোথায়?
ভাইয়ার বান্ডিলটা থেকে দাও। তুমি তো মাত্র পাঁচশ খরচ করেছ। বাকিটা তো আছে। এবং এই টাকাটা ভাইজানকে ফেরত দিতে হবে। কোনোই কাজে লাগবে না। মাঝখান থেকে আমার বন্ধুর জীবন রক্ষা হয়।
মনোয়ারা ক্ষিপ্ত গলায় বললেন, তোর এত বড় সাহস! তুই তো মানুষ না। তুই জানোয়ার। নিজের মাকে চোর বলছিস। তোর স্থান দোজখেও হবে না।
চুরি করেছ বলেই তো বলেছি। তুমি স্বীকারও করেছ। না স্বীকার করলে বেনিফিট অব ডাউট দেয়া যেত।
চুপ হারামজাদা।
মা একটা কিছু ব্যবস্থা কর। পাঁচ হাজার না পার, চার হাজার, চার না পার তিন…
তুই আমার সামনে থেকে যা। জীবনে আমার সামনে পড়বি না। আমি বাকি জীবন তোর মুখ দেখতে চাই না।
মা শোন, বড় ভাবির সঙ্গে আমার কথা হয়েছে। উনার ভাবভঙ্গি সুবিধার। মনে হয় স্যুটকেস-ট্রাঙ্ক সত্যি সত্যি খোলা হবে। তুমি অবশ্যই আমার ড্রয়ারে রেখে দিও। আগে মান-সম্মানটা বাঁচুক।
আমার সামনে থেকে যা। কোনোদিন আমার সামনে পড়বি না। কোনোদিন না। আমি বাকি জীবনে তোর মুখ দেখতে চাই না।
হারুন বসেছে প্রেসক্লাবের গেট থেকে একটু দূরে। শতরঞ্জি বিছিয়ে বসেছে। তার ডান পাশে ধবধবে সাদা রঙের বিশাল বালিশ। সামনে পিরিচে গুড়মুড়ি এবং ছোট এলাচ দানা রাখা। তার পেছনে বাঁশ পুতে বাঁশের মাথায় ছাতি দড়ি দিয়ে বাঁধা হয়েছে। ছাতার ছায়া হারুনের মাথায় পড়ে নি। ঘাড়ের উপর পড়েছে। হারুনের পেছনে নীল রঙের প্লাস্টিকের চেয়ার। সফিক চেয়ারগুলি দুদিনের জন্যে ডেকোরেটরের দোকান থেকে ভাড়া করে এনেছে। চেয়ারগুলি গোল করে বসানো। সেখানে সফিকের বন্ধুরা গম্ভীর ভঙ্গিতে বসা আছে। একটা বাচ্চা চাওয়ালাকে খবর দিয়ে আনা হয়েছে। তার সঙ্গে কনট্রাক্ট— সারাদিন সে সফিকের দলকে চা খাওয়াবে। বাইরে চা বিক্রি করতে পারবে না। বিনিময়ে চায়ের দাম তো পাবেই, এক্সট্রা পঞ্চাশ টাকা পাবে। চাওয়ালার নাম জতু। জতু অত্যন্ত আনন্দের সঙ্গে প্রস্তাবে রাজি হয়েছে। সে নিজেকে দলের অংশ হিসেবে ভাবছে। যেন সে এখন এক বিরাট জাতীয় কর্মকাণ্ডের অংশ। গুরুত্বপূর্ণ সদস্য।
সফিক তার দল নিয়ে চেয়ারে গোল হয়ে বসেছে। তাদের সবার হাতে চায়ের কাপ। তারা মাথা নিচু করে অতি গুরুত্বপূর্ণ কিছু সিদ্ধান্ত নেবার ব্যাপারে একমত হবার চেষ্টা করছে। কোনো ইস্যুতেই কেউ একমত হতে পারছে না। সবারই মেজাজ খারাপ হচ্ছে। হারুনের সামনে একটা পোস্টার লাগানো হবে— এই বিষয়ে সবাই একমত। পোস্টারের লেখা তৈয়ব লিখেছে। লেখাটার বিষয়েও সবাই একমত। তৈয়ব ইংরেজি সাহিত্যের ছাত্র। তার তিনটা ছোটগল্প পত্রিকায় ছাপা হয়েছে। সে খারাপ লিখবে না। লেখাটা ভালো হয়েছে। সমস্যা হলো পোস্টারটা হাতে লেখা হবে না কম্পিউটারে কম্পোজ করে সেঁটে দেয়া হবে সেটা নিয়ে। একদল বলছে, হাতে লেখা উচিত। হাতে লেখার মধ্যে একটা পার্সোনাল টাচ থাকে। ব্যাপারটা রিয়েলিস্টিকও হবে। বেকার মানুষ কম্পিউটার কম্পোজের টাকা পাবে কোথায়? আরেক দলের ধারণা কম্পিউটার কম্পোজ হওয়া উচিত। পোস্টার একটা থাকবে না, কয়েকটা থাকবে। হাতের লেখা পোস্টারের চেয়ে কম্পিউটার কম্পোজ ভালো। হার্ড ফ্যাক্ট গোটা গোটা হরফে লেখা থাকবে। কোনো কেলিওগ্রাফি না। বাস্তব সত্য। লেখাটা হলো—
আমার নাম হারুন-অর-রশিদ। না, আমি বাগদাদের খলিফা হারুন-অর-রশিদ না। আমি বেকার হারুন। গত পাঁচ বছর অনেক চেষ্টা করেও কোনো ব্যবস্থা করতে পারছি না। জীবনের প্রতি তীব্র ঘৃণা জন্মে গেছে। আমি প্রতিবাদ হিসেবে গায়ে আগুন জ্বেলে আত্মাহুতি দেবার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। আমার মৃত্যুতে কারোরই কিছু যাবে আসবে না। তাহলে কাজটা কেন করছি? প্রতিবাদ জানানোর জন্যে করছি। এ দেশের মানুষদের বেকার সমস্যার ভয়াবহতার দিকে দৃষ্টি ফেরাবার জন্যে করছি। হয়তো একটি প্রাণের বিনিময়ে হলেও সবাইকে একটা খবর পৌঁছাতে পারব। আমার মতো হাজার হাজার যুবকের অবস্থার দিকে একটু নজর দিন। একটু ভাবুন। আত্মাহুতির তারিখ ২ জুলাই, রাত বারোটা এক মিনিট। আপনার যদি কাজ না থাকে, চলে আসুন।
প্রেসক্লাবের সামনে। আত্মাহুতির সময়টা নিয়েও মতভেদ তৈরি হয়েছে। একদল বলছে, রাত বারোটা এক মিনিট ভালো সময়। মধ্যরাত। একটি দিনের শেষ, আরেকটা দিনের শুরু। আরেকদল বলছে— রাত বারোটা এক মিনিটে ঘটনা ঘটলে পত্রিকায় নিউজ ধরানো যাবে না। পত্রিকায় নিউজ ধরাতে হলে সন্ধ্যা ছটার মধ্যে কার্য সমাধা করতে হবে।
এক পর্যায়ে সফিক মহাক্ষিপ্ত হয়ে বলল, আমার ধারণা তোদের সবার মাথা খারাপ হয়ে গেছে। হারুনকে তো আমরা সত্যি সত্যি আগুনে পুড়তে দেব না। কাজেই রাত বারোটা এক মিনিটও যা, রাত তিনটাও তা। তোরা এমনভাবে কথা বলছিস যেন সে সত্যি সত্যি গায়ে আগুন দেবে। আমরা কাজটা করছি মিডিয়া অ্যাটেনশনের জন্যে। কাজেই রাত বারোটা এক মিনিট ফাইনাল। এই বিষয়ে আর কথা হবে না। এখন মূল বিষয়ে চলে আয়, আমরা হারুনের পাশে কেরোসিনের টিন, দেয়াশলাই এইসব রাখব কিনা।