মোফাজ্জল বারান্দায় তার যমজ দুই মেয়েকে শাস্তি দিতে নিয়ে এসেছে। ক খ দুজনকে মুখোমুখি বসানো হয়েছে। দুজনের গালে কষে থাপ্পড় লাগানো হয়েছে। এরা কেউ কাদছে না। দুজন দুজনের দিকে রাগী চোখে তাকিয়ে আছে। এদের এই এক অদ্ভুত ব্যাপার! যে শাস্তি দেয় এরা তার উপর রাগ করে না। এক বোন অন্য বোনের উপর রাগ করে। ফোস ফোস করতে থাকে। মুহিব এসে বারান্দায় দাঁড়াল। মোফাজ্জল ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে হুঙ্কার দিয়ে বলল, মুহিব, এক কাজ করতো, এই দুই শয়তানীর গালে কষে দুই থাপ্পড় দে।
মুহিব বলল, কেন?
প্রশ্ন করবি না। থাপ্পড় দিতে বলছি থাপ্পড় দে।
বলে নিজেই এসে থাপ্পড় দিল। ক উল্টে পড়ে গেল। আবার নিজে নিজেই উঠে বসে খ-এর দিকে তাকিয়ে ফোস ফোস করতে লাগল। মুহিব নিজের ঘরে ঢুকে গেল। সব বাবা-মারই সন্তান পালনের নিজস্ব টেকনিক আছে। এই টেকনিকে বাধা দেয়ার দরকার নেই। সংসার তার নিজস্ব গতিতে চলুক। কেউ বাচ্চাদের থাপ্পড় দিয়ে বড় করবে। আবার কেউ আদর দিয়ে বড় করবে। ফাইনাল প্রোডাক্ট কী হবে তা কেউই জানে না।
মুহিব বিছানায় পা এলিয়ে বসেছে। সারাদিনে সে কী করবে না করবে। একটু ভেবে নেয়ার ব্যাপার আছে। সফিক ভাইয়ের সঙ্গে যোগাযোগ করতে হবে। সিরিয়াস কিছু নিশ্চয়ই হয়েছে। সিরিয়াস কিছু না হলে তিনি ভোরবেলায় টেলিফোন করার মানুষই না। দলের কেউ কি মারা গেছে? সফিক ভাইয়ের মামার বাড়িতে কি কোনো সমস্যা হয়েছে? পুলিশ এসেছে। পুলিশ তাদের খুঁজছে? পুলিশ বড় ধরনের কোনো সমস্যা করতে পারবে না। মহসিনের মেজো চাচা পুলিশের ডিআইজি। পুরোপুরি দুই নম্বরি মানুষ। পুলিশের লাইনে দুনম্বরি মানুষের ক্ষমতা থাকে বেশি। মহসিন যদি সত্যি সত্যি কাউকে খুন করে তার ডিআইজি চাচাকে বলে, চাচা, খুন করে ফেলেছি। উনি বলবেন— কিছু দিনের জন্যে গা ঢাকা দে, ইন্ডিয়া চলে যা। দেখি কী করা যায়।
মহসিনের এই ডিআইজি চাচা অতি ধার্মিক মানুষ। একবার হজ করেছেন, দুবার উমরা হজ করেছেন। নামাজের কারণে কপালে দাগ পড়ে গেছে। তিনি যখন ডিউটিতে যান আর্দালির সঙ্গে জায়নামাজ থাকে। তার খাকি শার্টের পকেটে থাকে আকিক পাথরের তসবি। ডিউটিতে ফাঁক পেলে তসবি টানেন। মুহিব একবার মহসিনের সঙ্গে তার মেজো চাচার সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিল। তিনি খুব আদর-যত্ন করেছেন। তসবি টানতে টানতে পুলিশি ক্ষমতার অনেক গল্প করেছেন— বুঝলে বাবারা, সব কিছু পুলিশের হাতে। মনে কর B খুন করেছে C-কে। পুলিশ ইচ্ছা করলে A-কে খুনের মামলায় ফাঁসিয়ে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে দিতে পারে। পুলিশ এমন প্যাচ খেলবে যে শেষের দিকে A মনে করবে খুন সে-ই করেছে। হা হা হা। তাহলে একটা ঘটনা বলি শোন, আমি তখন টাঙ্গাইলের এস.পি…
মাগরেবের ওয়াক্ত পর্যন্ত তিনি তাদের একের পর এক গল্প বলে গেলেন। তাদের দুজনকে উনার ইমামতিতে মাগরেবের নামাজ পড়তে হলো। নামাজের শেষে তিনি এত আবেগের সঙ্গে দোয়া পড়লেন যে মুহিবের চোখ ছলছল করতে লাগল।
মুহিব!
জি ভাবি।
মুহিবের বড়ভাবি দরজার পাশ থেকে তার অতি বিরক্ত মুখ বের করে বললেন— তোমার টেলিফোন এসেছে, ধর। যাকে তাকে নাম্বার দিও না তো। সময়ে অসময়ে টেলিফোন করে, অতি বিরক্ত লাগে।
মুহিব বিছানা থেকে নামতে নামতে বলল, ইলিশ মাছটা পাঠিয়েছিলাম, কেমন ছিল ভাবি?
ভালো। টাকাটা পুরোটাই খরচ করেছ? বাচে নি কিছু? এক হাজার টাকা দিয়েছিলাম, পুরোটা তো লাগার কথা না।
একশ টাকার মতো বেচেছে।
যা বাচে ফেরত দিও। সব সময় চেয়ে টাকা নিতে হবে কেন? তোমার ভাইয়ের পঞ্চাশ হাজার টাকা যে চুরি গেছে শুনেছ?
জি।
তোমার ভাই বলছে–সবার বাক্স-প্যাটরা চেক করা হবে। আমি না করেছি, সে শুনছে না। শেষে কার না কার ব্যাগ থেকে টাকা বের হবে, নিজের আত্মীয়স্বজনদের মধ্যে…
ভাবি, তোমরা কি নিশ্চিত যে আমাদের মধ্যে কেউ নিয়েছে?
অবশ্যই।
কে নিয়েছে বলে তোমার অনুমান?
আগে টেলিফোন সেরে আস। তোমার বন্ধু কতক্ষণ টেলিফোন ধরে বসে থাকবে?
মুহিব টেলিফোন ধরতে গেল। টেলিফোন করেছে সফিক। তার গলা উত্তেজনায় কাঁপছে। অতি দ্রুত কথা বলছে বলে কথাও জড়িয়ে যাচ্ছে।
সকাল থেকে চেষ্টা করছি তোকে ধরার জন্য। এক্ষুণি চলে আয়। টেলিফোন রেখে দৌড় দিয়ে ঘর থেকে বের হবি। লাফ দিয়ে কোনো একটা চলন্ত বেবিটেক্সিতে উঠে পড়বি। স্ট্রেইট আমার বাসায়।
কী হয়েছে?
পত্রিকা পড়িস নাই? প্রথম আলোর লাস্ট পেজটা দেখেছিস?
না।
তোদের বাসায় কী পত্রিকা রাখা হয়?
জানি না।
প্রথম আলোর লাস্ট পেজ-এ হারুনের ছবি ছাপা হয়েছে।
কেন?
সে প্রেসক্লাবের সামনে গতরাত বারোটা থেকে বসে আছে। ঘোষণা দিয়েছে তার জন্মদিনে অর্থাৎ জুলাইয়ের দুই তারিখে বেকার গায়ে কেরোসিন ঢেলে জীবন বিসর্জন দেবে।
কেন?
বেকার সমস্যার দিকে জনগণের দৃষ্টি ফেরাবার জন্যে। হারুনের পেটে যে এই জিনিস ছিল কোনোদিন বলেছে? আশ্চর্য ছেলে! সকালে পত্রিকা দেখে আমার তো ব্রেইন আউলা হয়ে গেল। কোনো রকম আলোচনা নাই, কিছু নাই, হুট করে এত বড় ডিসিশান! যাই হোক, এখন পুরো দায়িত্ব আমাদের নিতে হবে। কবি-সাহিত্যিক, অভিনেতা, গায়ক, বুদ্ধিজীবী সবার কাছে ছোটাছুটি করতে হবে। সিরিয়াস জনমত তৈরি করতে হবে। আমাদের দলের সবাইকে এক হাজার টাকা করে চাঁদা দিতে হবে। অনেক খরচাপাতির ব্যাপার আছে। একটা পোস্টার ছাপাতে হবে। নীরব ঘাতক সাবেরের মামার প্রেস আছে। সাবেরকে সঙ্গে নিয়ে উনার পায়ে পড়ব। বলব, মামা আপনার পায়ে ধরলাম। রাজি না হওয়া পর্যন্ত পা ছাড়ব না। আমরা কাগজ কিনে দিচ্ছি, আপনি চার কালারের একটা পোস্টার ছেপে দিন। হারুনের সুন্দর একটা ছবিও তুলতে হবে। হতাশ চেহারা বড় বড় চোখে তাকিয়ে আছে টাইপ। তোর চেনাজানা কোনো ফটোগ্রাফার আছে?