মুহিব উঠে বসতে বসতে বলল– মা শোন, আমি যখন ক্লাস সেভেনে পড়ি তখন তুমি বাবার মানিব্যাগ থেকে তিন হাজার টাকা সরিয়েছিলে। তারপর নিজেই টাকা চুরির জন্যে দোষী সাব্যস্ত করলে আমাদের বাসার কাজের ছেলেটাকে। তার নাম ছিল রুকু। তুমি তাকে এমন মার মারলে যে তার বাঁ হাত ভেঙে গেল। বাবা তাকে হাসপাতালে নিয়ে সেই হাত প্লাস্টার করিয়ে আনলেন।
মনোয়ারা ফোঁপাতে ফোঁপাতে বললেন, তোর মতো ছেলে আমি কী করে পেটে ধরলাম? এই ছেলে নিজের মাকে বলছে চোর?
মুহিব শান্ত গলায় বলল, মা শোন, ফোঁসফোসানি বন্ধ কর। তোমার ভাবভঙ্গি থেকে পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে টাকাটা তুমি নিয়েছ। বড়ভাবি অবশ্যই তোমাকে সন্দেহ করছেন। সন্দেহ করছেন বলেই বলা হচ্ছে সবার ট্রাঙ্কস্যুটকেস চেক করা হবে। তোমার কাছে টাকাটা পাওয়া গেলে খুবই কেলেঙ্কারী ব্যাপার হবে। তুমি এক কাজ কর টাকাটা এক্ষুণি এনে আমার ড্রয়ারে রাখ। পুরোটাই আছে, না কিছু খরচ করে ফেলেছ? মা, ঠিকঠাক জবাব দাও। আমি তোমাকে সাহায্য করতে চাই। পুরো টাকাটা আছে?
পাঁচশ খরচ করেছি।
আমার জন্যে এক কাপ চা নিয়ে এসো, আর বাকি টাকাটা এনে আমার ড্রয়ারে রেখে দাও।
মনোয়ারা চোখ মুছে ছেলের ঘর থেকে বের হয়ে গেলেন।
ছুটির দিনের সকাল অনেক দেরিতে শুরু হয়। মুহিব সেই হিসেব করে সাড়ে দশটার দিকে ঘর থেকে বের হলো। তার কাছে পরিস্থিতি খুবই স্বাভাবিক মনে হচ্ছে। যে টেনশনে মনোয়ারা মুখ শুকনো করে ঘুরে বেড়াচ্ছিলেন কোথাও তার ছোঁয়া দেখা গেল না। মুহিবের বড় ভাই তোফাজ্জল খবরের কাগজ হাতে নাস্তার টেবিলে। ছুটির দিন হিসেবে স্পেশাল নাশতা বানানো হয়েছে— খাসির মাংসের তেহারি। তোফাজ্জলের সামনে প্লেট ভর্তি তেহারি। সে খুবই আগ্রহের সঙ্গে তেহারি খাচ্ছে এবং পত্রিকা পড়ছে। পঞ্চাশ হাজার টাকার একটা বান্ডিল চুরি হয়েছে, তার ছাপ তোফাজ্জলের মুখে নেই। বরং তাকে আনন্দিত দেখাচ্ছে।
মুহিব কিছু বলল না।
তোফাজ্জল বলল, চাকরি-বাকরি নেই, তোর চেহারা তো চিমসে মেরে যাওয়ার কথা। অথচ যত দিন যাচ্ছে তোর চেহারা খোলতাই হচ্ছে। রহস্যটা কী?
এই প্রশ্নের জবাব হলো লজ্জিত ভঙ্গির হাসি। সেই হাসি কেন যেন আসছে al
তুই এক কাজ কর মতিঝিল এলাকায় ঘোরাঘুরি না করে এফডিসি এলাকায় ঘোরাঘুরি কর। কোনো পরিচালকের নজরে পড়লে তোক ফিল্মে নিয়ে নিবে। আমি কিন্তু ঠাট্টা করছি না। আমি সিরিয়াস।
মুহিব ভাইয়ের পাশে বসেছে। সকালবেলায় তৈলাক্ত তেহারি দেখে গা গুলাচ্ছে। বেগুন ভাজা দিয়ে রুটি খেতে ইচ্ছা করছে। ঘরে বেগুন অবশ্যই আছে। দুটা রুটি সেঁকে দিতে বেশি যন্ত্রণা হবার কথা না। সেই নির্দেশ মুহিব দিতে পারছে না।
তোফাজ্জল মুখের উপর থেকে পত্রিকা নামিয়ে বলল, সফিক নামে তোর কোনো বন্ধু আছে?
মুহিব বলল, আছে।
কমনসেন্স বলে একটা জিনিস যে বাজারে প্রচলিত আছে তার ব্যাপারে সেটা মনে হলো না। I am so annoyed.
কী করেছে?
ভোর ছটার সময় টেলিফোন করে তোকে চাচ্ছে। আমি বললাম, জরুরি কিছু? সে বলল— না, জরুরি কিছু না।
আমি বললাম, জরুরি কিছু না হলে পরে টেলিফোন করো। ছুটির দিনে ভোর ছটায় জরুরি কোনো কারণ ছাড়া টেলিফোন করা অপরাধের মধ্যে পড়ে। সে টেলিফোন রেখে দিয়ে ঠিক বিশ মিনিটের মাথায় আবার টেলিফোন করেছে। আমি স্টুপিড বলে গালি দিতে চাচ্ছিলাম। শেষ মুহূর্তে নিজেকে সামলিয়েছি। তুই তোর বন্ধুকে বলে দিস সে যেন কখনো ছুটির দিনে দশটার আগে টেলিফোন না করে।
জি আচ্ছা, বলে দেব।
তুই আবার আমার কথায় রাগ করছিস না তো? বেকার যুবকরা অতিরিক্ত সেন্টিমেন্টাল হয়। তারা ধরেই নেয় পৃথিবীর সবাই তাদেরকে অপমান করার জন্যে ব্যস্ত হয়ে আছে। তুই বরং এক কাজ কর, নাস্তা খেয়ে তোর বন্ধুর সঙ্গে টেলিফোনে কথা বল। ঘটনা কী জান। নিশ্চয়ই কোনো সমস্যা আছে, নয়তো ভোর ছটায় কেউ টেলিফোন করে না।
মুহিব টি-পট থেকে কাপে চা ঢালল। চায়ের কাপ হাতে নিয়ে নিজের ঘরে চলে যাওয়া, বিছানায় পা ছড়িয়ে ছুটির দিনের মতো চা খাওয়া। চা খেতে খেতে এক ফাঁকে অ্যাপয়েন্টমেন্ট লেটারটা পড়া যেতে পারে। বৃষ্টির পানিতে কাগজটা প্রায় গলন্ত অবস্থায় চলে গিয়েছিল। সেটা শুকানো হয়েছে। শক্ত কাগজে পেস্ট করা হয়েছে। একবার লেমনেট করার চিন্তাও এসেছিল। জীবনের প্রথম চাকরির অ্যাপয়েন্টমেন্ট লেটারটা যত্ন করে রেখে দেয়া হলো।
তোফাজ্জল বলল, কিরে তুই উঠে যাচ্ছিস কেন?
ঘরে বসে চা খাব।
ঘরে বসে চা খাবার দরকার পড়ল কেন? সিগারেট ধরেছিস?
না।
মিথ্যা বলার দরকার নেই। ধরলে ধরেছিস। সামান্য সিগারেট নিয়ে মিথ্যা বলা ঠিক না। ছোট মিথ্যা থেকে শুরু হয় বড় মিথ্যা। ইংরেজিতে একটা প্রবচন আছে— You start by cutting grass, you end up by killing man. আচ্ছা যা, ঘরে গিয়ে সিগারেট খেতে খেতে আরাম করে চায়ে চুমুক দে। সিগারেট দিয়ে সকালের চার কোনো তুলনা নেই। পাঁচ বছর আগে সিগারেট ছেড়েছি, এখনো স্মৃতি আছে। কিছুই বলা যায় না কোনো একদিন সিগারেট ধরে ফেলতে পারি। May be today is the day.
মুহিব ভেবেই পাচ্ছে না বড় ভাইজান আজ এত কথা বলছেন কেন? টাকা হারানোর শোকে? টেনশনে একেকজন মানুষ একেক রকম আচরণ করে। মুহিবের মেজো ভাই মোফাজ্জল ঝিম মেরে বিছানায় পড়ে যায়। তার তখন ড্রপ বিট হয়। এবং সে বিড়বিড় করে বলে— Oh God, save me please. তার ধারণা, তার বেহেশত হবে টেনশন ফ্রি একটা জায়গায়। বেহেশতে তার হুরপরী, সরাবন তহুরা কিছুই লাগবে না। শুধু শুয়ে থাকার জন্যে নরম বিছানা লাগবে। শব্দ হয় না এরকম এসি লাগবে। আর লাগবে টেনশন ফ্রি মন।