অবশ্যই ফেরত দেব।
তোমার ভাইয়ের এক মহিলা কলিগ আছেন, নায়লা নাম। উনার মনে হয় কোনো কাজকর্ম নাই। প্রতিদিন একটা রান্নার রেসিপি বলেন। তোমার ভাই সেটা মাথায় করে বাসায় নিয়ে আসে।
মুহিব গলা নামিয়ে বলল, প্রেম-ট্রেম হয়ে যায় নি তো ভাবি?
আমার সঙ্গে রসিকতা করবে না। আমার রসিকতা ভালো লাগে না।
সরি।
বড়চাচা তোমাকে ডাকছেন। উনিও কী যেন আনাবেন। তাঁর সঙ্গে দেখা করে যেও। আর দয়া করে এক্ষুণি একটা কাগজে লিখে নাও কী কী আনতে হবে।
মুহিব আবারো বাথরুমে ঢুকল। জল-চিকিৎসায় চোখের কিছু হয় নি। শেভ করে মোটামুটি ভদ্রস্থ হবার চেষ্টা করা দরকার। তার চোখের এই অবস্থাটা ভাবি লক্ষ করেন নি। এটা খুবই আশ্চর্যজনক ঘটনা। মনে হচ্ছে এই বাড়ির কেউ এখন তার দিকে ভালো করে তাকায় না। তাকালেও কিছু দেখে না। বোধহয় সে H. G. Wells-এর অদৃশ্য মানব হয়ে যাচ্ছে। একটা পরীক্ষা করা যেতে পারে। সবার সামনে কিছুক্ষণ ঘোরাঘুরি করবে। অকারণেই কিছু কথাবার্তাও বলা হবে। দেখতে হবে যাদের সামনে ঘোরাঘুরি করা হলো তাদের মধ্যে কতজন বলে–আরে, চোখে কী হয়েছে? কেউ বলবে এরকম মনে হচ্ছে না।
তৌফিকুর রহমান দোতলার বারান্দায় ইজিচেয়ারে আধশোয়া হয়ে আছেন। তার পায়ের পাতা রোদে, তিনি ছায়াতে। পায়ের পাতায় ওলিভ ওয়েল মাখানো। ওলিভ ওয়েল সূর্যের ক্ষতিকারক আলট্রা ভায়োলেট রশ্মি থেকে পা-কে রক্ষা করবে, আবার সূর্যের উপকারী রশ্মি যা শরীরে ভিটামিন ডি তৈরি করবে তাকে বাধাগ্রস্ত করবে না। তৌফিকুর রহমানের হাতে বিজ্ঞানের একটা বই। লেখকের নাম মিশিও কাকু। বইটার নাম হাইপার স্পেস। ভোরবেলায় তিনি ধর্ম এবং বিজ্ঞানের বই পড়েন। রাতে পড়েন বিকল্প চিকিৎসা পদ্ধতি বিষয়ক বই। তৌফিকুর রহমান সাহেবের বয়স ষাটের উপরে। চিরকুমার থাকার কারণে কিংবা নানাবিধ চিকিৎসা পদ্ধতির কারণে চেহারায় বয়সের ছাপ পড়ে নি। যুবক বয়সে তিনি যে অত্যন্ত সুপুরুষ ছিলেন তা এখনো বোঝা যায়। নিজের পোশাকআশাক নিয়ে তিনি অত্যন্ত সচেতন। এই ভোরবেলাতেও তিনি ইস্ত্রি করা পাঞ্জাবি পরেছেন। নীল পাড়ের ধবধবে সাদা লুঙ্গি। কোলের উপর ঘিয়া রঙের পাতলা মটকার চাদর ফেলে রাখা। এখন আষাঢ় মাস। চাদরের প্রয়োজন নেই। এই চাদরটা তার সাজসজ্জার অংশ।
মুহিব বড়চাচার পাশে এসে দাঁড়াল। তৌফিকুর রহমান বই থেকে মুখ না তুলেই বললেন, গুড মর্নিং। তোর খবর কী?
মুহিব বলল, আমার খবর ভাললা। আপনি আমাকে ডেকেছেন?
না তো। ভোরবেলাটা আমি একা থাকতে পছন্দ করি। কাউকে ডাকাডাকি করি না।
মুহিব বলল, বড় ভাবির কাছে শুনলাম আপনি ডেকেছেন।
তৌফিকুর রহমান বই থেকে চোখ তুললেন। ইজিচেয়ারে সোজা হয়ে বসতে বসতে বললেন, মনে পড়েছে। বড় বৌমাকে বলেছিলাম তোকে খবর দিতে। তুই একবার সময় করে স্বর্ণকারের দোকানে যাবি। আমি রুপা এবং সোনা দিয়ে দুটা হামানদিস্তা বানাব। কত খরচ পড়বে জেনে আসবি।
রুপা-সোনা দিয়ে হামানদিস্তা বানাতে হবে কেন?
তৌফিকুর রহমান আগ্রহের সঙ্গে বললেন, রুপা আর সোনা হলো নন রিঅ্যাকটিভ মেটাল। নোবেল মেটাল। আমি যে-সব ওষুধপত্র বানাচ্ছি তার সঙ্গে নোবেল মেটালের তৈরি হামানদিস্তার কোনো রি-অ্যাকশন হবে না।
রুপা নন রি-অ্যাকটিভ আপনাকে কে বলল? কিছুদিন রেখে দিলেই সিলভার অক্সাইডের কালো আস্তর পড়ে যায়। সোনা দিয়ে বানাতে পারেন। আধ সেরের মতো সোনা লাগবে। ছয় হাজার টাকা করে তোলা। লাখ দুএক টাকা লাগবে।
বলিস কী? এ তো দেখি বিরাট প্রবলেম!
পাথরের হামানদিস্তা ব্যবহার করতে পারেন। পাথর ইনার্ট বস্তু। পাথর কোনো রি-অ্যাকশন ফি-অ্যাকশনে যাবে না। ঝিম ধরে থাকবে।
তৌফিকুর রহমান উৎসাহের সঙ্গে বললেন, কথাটা ভালো বলেছিস। পাথরের হামানদিস্তার কথা আমার মনেই আসে নি। সোনা-রুপা নিয়ে ঘটঘট করছি। তুই খোঁজ নে— কী রকম দাম, কোথায় পাওয়া যায়।
আচ্ছা।
জলপাই পাতার এক্সট্রাক্ট খাচ্ছিস তো?
হুঁ।
কী মনে হয়, উপকার পাচ্ছিস?
বুঝতে পারছি না।
বুঝতে পারবি না কেন? শরীরে সতেজ ভাব আসছে না?
আসছে মনে হয়।
ট্রিটমেন্ট শুরুর আগে একবার লিপিড প্রোফাইল করানো হয়েছে। এক মাস পার হবার পর একটা লিপিড প্রফাইল করাবি। আগেরটার সঙ্গে মিলিয়ে দেখব অবস্থা কী। আসলে আমাদের সঙ্গে একজন ফুলটাইম ডাক্তার থাকা দরকার। তোর বন্ধু-বান্ধবের মধ্যে ডাক্তার আছে?
নাহ্। আমার সবই বেকার বন্ধু-বান্ধব। এদের মধ্যে যারা যারা চাকরি পাচ্ছে, তাদের সঙ্গে সম্পর্ক শেষ হয়ে যাচ্ছে। বেকাররা বেকার ছাড়া অন্য কারো সঙ্গে মিশতে পারে না।
চাকরির ব্যাপারটা মাথা থেকে দূর করে দে। স্বাধীনভাবে কিছু করার চিন্তাভাবনা কর। দুইশ বছর ব্রিটিশদের গোলামি করার ফল এই হয়েছে— জাতিগতভাবে আমাদের ডিএনএ-র ভিতর ঢুকে গেছে যে-কোনোভাবে একটা চাকরি করতে হবে। তুই এর ভেতর থেকে বের হয়ে আসার চেষ্টা কর।
দেখি।
দেখাদেখির কিছু নেই। কনক্রিট চিন্তা-ভাবনা করে আমার কাছে আয়। অল্প-স্বল্প ক্যাপিটেলের ব্যবস্থা করা যাবে। আমার নিজেরও কিছু চিন্তা-ভাবনা
বড়চাচা, এখন তাহলে যাই?
আচ্ছা যা, জলপাই এক্সট্রাক্ট-টা খেতে ভুল করবি না। রোজ ভোরবেলা একটা করে ট্যাবলেট।
ওষুধটার একটা নাম দেন না কেন! এক্সট্রাক্ট শুনতে যেন কেমন লাগে।