এমন উদাহরণ আছে। সফিকের বেলায় এ ধরনের ঘটনা ঘটেছে। নান্দাইল গার্লস কলেজে ইতিহাসের লেকচারার পোস্টে অ্যাপয়েন্টমেন্ট লেটার পেয়ে সে বিছানা বালিশ নিয়ে জয়েন করতে গেল। কলেজের প্রিন্সিপ্যাল সাহেব তাকে চা-টা খাইয়ে আদর-আপ্যায়ন করে বললেন— ক্ষুদ্র একটা সমস্যা হয়েছে। মন্ত্রীর সুপারিশে এডহক ভিত্তিতে একজনকে নিয়ে নেয়া হয়েছে। আপনি বরং গভর্নিং কমিটির সেক্রেটারি সাহেবের সঙ্গে কথা বলেন।
সফিক বলল, উনার সঙ্গে কথা বলে কী হবে?
প্রিন্সিপ্যাল সাহেব বললেন, কিছুই হবে না। মনের শান্তি।
মনের শান্তি দিয়ে আমি করব কী? প্রি
ন্সিপ্যাল সাহেব গম্ভীর গলায় বললেন, সেটাও একটা কথা।
চাকরি নিয়ে মুহিবের ভালোরকম দুশ্চিন্তা আছে বলেই সে প্রতিরাতেই চাকরি নিয়ে দুঃস্বপ্নের মতো দেখছে। গত রাতের দুঃস্বপ্ন হলো— সে জয়েন করতে গিয়েছে। ম্যানেজার সাহেব একটা কাগজ বের করে বললেন, এখানে সই করুন। মুহিব বলল, আপনার কলমটা একটু দিন। ম্যানেজার সাহেব চোখ সরু করে বললেন, কলম ছাড়া চাকরি করতে এসেছেন! এরকম ঘটনা আমার জীবনে ঘটে নি। আপনি শুধু যে কলম ছাড়া চাকরি করতে এসেছেন তা না, লুঙ্গি পরে চলে এসেছেন। খালি পায়ে এসেছেন, না-কি পায়ে স্যান্ডেল আছে?
মুহিব তাকিয়ে দেখল সত্যি সত্যি তার পরনে লুঙ্গি। পা খালি। এক পা কাদায় মাখামাখি।
টেনশনে সে ঘেমে গেল। তার বুক ধড়ফড় করতে লাগল। বুক ধড়ফড়ানি নিয়েই তার ঘুম ভাঙল। যতই দিন যাচ্ছে ততই মুহিব নিশ্চিত হচ্ছে চাকরি হবে না।
দরজায় টুকটুক শব্দ হচ্ছে। মুহিব সাড়া দিল না। সকালবেলাতেই টুকটুকানি ভালো লাগে না।
মুহিব, দরজা খোল।
মায়ের গলা। মুহিব বিছানা থেকে নামল। ছুটির দিনের সকালবেলায় মাতৃমুখ দর্শন তার জন্যে কোনো সুখকর ব্যাপার না। তাকে কোথাও যেতে হবে। সম্ভাবনা শতকরা ৯০ ভাগ যে মনোয়ারা তাকে তার বড় মেয়ের কাছে গোপন চিঠি দিয়ে পাঠাবেন।
মনোয়ারা তার বড় মেয়ের সঙ্গে গোপন চিঠি চালাচালি করেন। মুহিব পোস্টম্যান। আজও মনে হয় রানারের ভূমিকা পালন করতে হবে।
মুহিব দরজা খুলল। মনোয়ারা চায়ের কাপ হাতে গম্ভীর মুখে দাঁড়িয়ে আছেন। এটা একটা বিস্ময়কর ঘটনা।
নে চা খা।
হঠাৎ চা! ব্যাপার কী মা?
বড় বৌমা তোফাজ্জলের জন্যে চা বানিয়ে নিয়ে যাচ্ছিল। আমি বললাম, মুহিবের জন্যেও এক কাপ বানাও।
শুধু চা দিতে এসেছ? না-কি আরো কিছু বলবে। বড় আপার কাছে যেতে হবে?
মনোয়ারা ছেলের ঘরে ঢুকতে ঢুকতে বললেন, তুই কি ঘটনা কিছু শুনেছিস?
কী ঘটনা?
গতকাল রাতে তুই বাসায় ছিলি না?
না।
কোথায় ছিলি?
আমার এক বন্ধুর মামার বাসায় ছিলাম।
এই জন্যেই তুই কিছু জানিস না। গতকাল রাতে তোফাজ্জলের টাকা চুরি গেছে। পঞ্চাশ হাজার টাকার একটা বান্ডিল। ড্রেসিং টেবিলের উপরে টাকাটা ছিল।
এত টাকা বাসায় ছিল?
ওরা কালার টিভি কিনবে। আলাদা টিভি দেখবে। বৌমার বুদ্ধি। এই মেয়ে ছেলেটার মাথা খারাপ করে দিচ্ছে। আলাদা টিভি দেখার কী আছে তুই বল। এইসব আমার এখন আর ভালো লাগে না। আমি ঠিক করেছি এদের সঙ্গে থাকব না।
থাকবে কোথায়?
মনোয়ারা চুপ করে রইলেন।
চিন্তা করে বের কর কোথায় থাকতে চাও। আমি দিয়ে আসব।
মনোয়ারা সরু গলায় বললেন, মাকে কোথাও ফেলে দিয়ে আসার জন্যে তুই এত ব্যস্ত?
মুহিব বলল, তুমি যেতে চাচ্ছ বলেই তোমাকে রেখে আসতে চাচ্ছি। মাতৃ আদেশ পালন করছি। চা-টা ভালো হয়েছে। আরেক কাপ চা খাওয়াতে পারবে?
মনোয়ারা জবাব দিলেন না। চিন্তিত মুখ করে বসে রইলেন।
মুহিব বলল, মা, তোমার কথা শেষ হয়েছে না আরো কিছু বলবে?
মনোয়ারা বললেন, তোর এখানে বসে থাকলে কি কোনো সমস্যা আছে?
কোনো সমস্যা নেই। সারাদিন বসে থাক।
ফাজিলের মতো কথা বলছিস কী মনে করে? বাংলাদেশের কোনো ছেলেকে দেখেছিস মায়ের সঙ্গে এইভাবে কথা বলে? সব রসুনের এক পাছা। তোরা তিন ভাই-ই এক রকম। তোদের মধ্যে তোফাজ্জল হচ্ছে হাড়ে গোশতে বদ। বউ-এর চোখের ইশারায় চলে। এখন হুকুম জারি করেছে প্রত্যেকের ট্রাঙ্কস্যুটকেস খুলে চেক করা হবে। টাকার জন্যে চাকর-বাকরদের পুটলা-পুটলি চেক করা এক কথা, আর প্রত্যেকের ট্রাঙ্ক-সুটকেস চেক করা ভিন্ন কথা। এখন মনে কর, তোর বড়চাচার স্যুটকেস খোলা হলো–ব্যাপারটা তোর বড়চাচার কেমন লাগবে?
মুহিব হাই তুলতে তুলতে বলল, যদি বড়চাচার স্যুটকেস খুলে পঞ্চাশ হাজার টাকার বান্ডিলটা পাওয়া যায় তাহলে খুব খারাপ লাগবে। মা শোন, আমি ঠিক করেছি আবার ঘুমিয়ে পড়ব। ঘুমের দ্বিতীয় অধিবেশন। কাজেই এখন চলে যাও।
ঘর থেকে বের করে দিচ্ছিস! তোর এত বড় সাহস? নিজের মাকে বলতে পারলি ঘর থেকে এক্ষুণি বের হয়ে যাও।
এরকম কঠিন করে তো মা বলি নি। সফটলি বলেছি।
মনোয়ারা উঠে দাঁড়ালেন। তাঁর ভঙ্গি দেখে মনে হচ্ছে তিনি এক্ষুণি কেঁদে ফেলবেন। মুহিব বিছানায় শুয়ে পড়তে পড়তে বলল, মা, আমার একটা উপদেশ শোন। ভাইজানের কাছ থেকে তুমি যদি টাকাটা সরিয়ে থাক তাহলে আমার কাছে পাচার করে দাও। তোমার স্যুটকেস থেকে টাকা বের হলে তুমি বিরাট লজ্জার মধ্যে পড়বে।
তুই কী বললি? কী বললি তুই?
কী বলেছি তুমি তো শুনেছ।
মনোয়ারা কেঁদে ফেললেন। শাড়ির আঁচলে চোখ ঢেকে ফুপিয়ে উঠলেন। ভাঙা গলায় বললেন নিজের মাকে নিয়ে এমন একটা কুৎসিত কথা তুই কীভাবে ভাবলি?