D4 ফ্ল্যাটের মালিক আব্দুল গফুর সাহেবের ভাগ্নে সফিকের আমি বন্ধু।
ও আচ্ছা আচ্ছা।
মুহিব বলল, গফুর মামা সফিকের উপর খুব রাগ করেছেন। উনি বলেছেন। সবগুলি ঘর দেখিয়ে তারপর যেন আপনার হাতে চাবি দেয়া হয়।
বাবা কোনো দরকার নেই। তুমি চাবিটা আমার কাছে দিয়ে যাও।
গফুর মামা ঘরগুলি দেখিয়ে আপনার হাতে চাবি দিতে বলেছেন। উনি খুবই আপসেট।
আমার আসলে উনাকে কিছু জানানোই উচিত হয় নি। তোমাকে দেখে এখন তো আমার নিজের কাছেই খুব খারাপ লাগছে। আসলে হয়েছে কী, একটা ছেলেকে সম্পূর্ণ নগ্ন অবস্থায় সিঁড়ি দিয়ে নামতে দেখে… আমি নিজেই দেখলাম। সে আমাকে দেখে মোটেই লজ্জা পেল না। খুবই স্বাভাবিক গলায় বলল, হ্যালো মিস্টার।
মুহিব ছোট্ট নিঃশ্বাস ফেলে বলল, ও আমাদের বন্ধু। মহসিন নাম। জুলজিতে M.Sc পাস করেছে। অনার্স এমএসসি দুটাতেই ফার্স্টক্লাস পাওয়া। তিন বছর চেষ্টা করেও কোনো চাকরি পাচ্ছিল না। মনটন খুব খারাপ থাকত। হঠাৎ খবর এসেছে তার মা মারা গেছে। আমরা তাকে সান্ত্বনা দেবার জন্যেই এই বাড়িতে নিয়ে এসেছিলাম। খবরটা শোনার পর হঠাৎ কী যেন হলো।
বলো কী! খুবই দুঃখজনক ঘটনা। আমার বোঝার ভুল।
ভদ্রলোক মেয়ের দিকে তাকিয়ে হতাশ গলায় বললেন, যূথী মা, দেখ তো কী লজ্জার মধ্যে পড়লাম— মার মৃত্যুতে একটা ছেলের সুখে-দুখে মাথা ইয়ে হয়ে গেছে আর আমি কি-না… ছিঃ ছিঃ।
যূথী বলল, বাবা, তুমি উনার সঙ্গে যাও। ঐ ভদ্রলোক যদি থাকেন তার কাছে ক্ষমা চাও।
অবশ্যই ক্ষমা চাইব। বাবা, তোমার নাম কী?
আমার নাম মুহিব।
চা খাও।
জি-না, আমি চা খাব না।
চা তো খেতেই হবে। চলো উপরে যাই, সবার সঙ্গে কথা বলে আসি। তারপর না হয় সবার সঙ্গেই চা খাব। মুহিব বাবা শোন, এ হলো আমার বড় মেয়ে— ডাক নাম যূথী। ভালো নাম শায়লা। খুবই ভালো ছাত্রী। এসএসসিতে ছেলেমেয়ে সবার মধ্যে ফিফথ হয়েছে। মেয়েদের মধ্যে প্রথম। এর ছোট্ট একটা ইন্টারভিউ বিটিভিতে প্রচার করেছিল। টিভিতে তাকে অবশ্যি অনেক বড় বড় লেগেছে। আমি নিজেই চিনতে পারি নি।
যূথী লজ্জিত গলায় বলল, বাবা চুপ করো তো।
ভদ্রলোক মুহিবের দিকে তাকিয়ে বললেন, বাবা চলো যাই।
আরজু সাহেব আজমীর মামার শোবার ঘরের দরজার পাশে দাঁড়িয়ে আছেন। তার শরীর কাঁপছে। কপাল ভর্তি ঘাম। কপালের ঘাম নাক বেয়ে টুপটুপ করে পড়ছে। তিনি ভাঙা গলায় বললেন, এখানে কী হয়েছে?
সফিক বলল, তেমন কিছু হয় নি। আমরা কাটাকুটি খেলেছি।
তার মানে কী?
সব কিছুর মানে কি পরিষ্কার করে বলা যায়? বলা যায় না। বলা উচিতও না।
আমি কিছু বুঝতে পারছি না।
সাবের বলল, বুঝতে না পারাই তো ভালো। এই জগতে যত কম বুঝবেন তত ভালো। বেশি বুঝলে ধরা খেয়ে যাবেন। একজন বেশি বুঝেছিল বলে ধরা খেয়েছে মামার শোবার ঘরটা নোংরা হয়েছে।
আমি যাই।
সাবের বলল, অবশ্যই যাবেন। যাবার আগে আমাদের জন্যে ছোট্ট একটা কাজ করে দিতে হয় যে।
আরজু সাহেব কাঁদো কাঁদো গলায় বললেন, কী কাজ?
মফিজ বলল, আমাদের বন্ধু যেমন নেংটো হয়ে সিঁড়ি দিয়ে দৌড়ে গিয়েছিল সে-রকম একটা নেংটা দৌড় দেবেন। আপনার পরনে লুঙি। নেংটা হওয়া আপনার জন্যে কোনো ব্যাপারই না।
আরজু সাহেব বললেন, বাবা তুমি কী বলছ?
নেংটা হতে যদি লজ্জা লাগে তাহলে তারও ওষুধ আছে। দুগ্লাস মাল খেয়ে নিন। দেখবেন লজ্জা-শরম কোথায় চলে যাবে।
ভদ্রলোক বিড়বিড় করে বললেন, মাল খাব। মাল।
মহসিন এগিয়ে এসে আচমকা টান দিয়ে ভদ্রলোকের লুঙি খুলে ফেলল। তিনি কোনো আপত্তি করলেন না বা চেঁচিয়ে উঠলেন না। অদ্ভুত দৃষ্টিতে সবার দিকে তাকাতে লাগলেন। একবার শুধু বিড়বিড় করে ডাকলেন— যূথী, ও মা যূথী।
বেকার মানুষদের সবচে অস্বস্তিকর দিন
বেকার মানুষদের জন্যে সপ্তাহের সবচে অস্বস্তিকর দিন হলো ছুটির দিন। যারা কাজেকর্মে থাকে এই দিনে তাদের মধ্যে ঢিলে ভাব চলে আসে যেন পায়জামার গিঁঠ বেশ খানিকটা আলগা করে দেয়া হলো। পা নাচানোর অভ্যাস যাদের নেই তাদেরকেও দেখা যায় খবরের কাগজ মুখের সামনে ধরে পা নাচাচ্ছে। বেকাররা পড়ে যায় অস্বস্তিতে। ছুটির দিনগুলির সঙ্গে নিজেদের মিলাতে পারে না। তাদের মধ্যে বোকা বোকা ভাব চলে আসে।
মুহিবকে এখন বেকার বলার কোনো কারণ নেই। চাকরিতে জয়েন সে করে নি, কিন্তু এক তারিখেই করবে। ছুটির দিনে তার অস্বস্তি বোধ করার কোনো কারণ নেই। সে অবশ্যই একটা খবরের কাগজ কিনে এনে পা দোলাতে দোলাতে পড়তে পারে। খবরের কাগজ কিনতে হবে কারণ এ বাড়িতে যে দুটা কাগজ রাখা হয় তার কোনোটাই দুপুরের আগে রিলিজ হয় না। একটা ইংরেজি কাগজ তৌফিকুর রহমান সাহেব রাখেন। এই কাগজটা তিনি পড়েন দুপুরের খাওয়া-দাওয়ার পর বিছানায় শুয়ে শুয়ে। দুপুরের খবরের কাগজ না পড়লে তার ঘুম হয় না। যে-সব বিশেষ বিশেষ দিনে কাগজ বের হয় না সে-সব দিনগুলিতে তাঁর খুবই সমস্যা হয়। সন্ধ্যা পর্যন্ত বিছানায় গড়াগড়ি করেন। ঘুম আসে না। দ্বিতীয় কাগজটা বাড়ির সবার জন্যে। এই কাগজ হাতে পাওয়া খুব সমস্যা। কাগজটা কে আগে পড়বে এই নিয়ে ঠাণ্ডা স্নায়ুযুদ্ধও হয়। মনোয়ারা বাড়ির কত্রী হিসেবে কাগজটা প্রথম পড়বেন এরকম আশা করেন। তিনি কাগজ কখনোই আগে হাতে পান না।
মুহিব ঠিক করে রেখেছে যেদিন চাকরিতে জয়েন করবে সেদিন থেকে হকারকে বলে দেবে চারটা বাংলা কাগজ দিয়ে যেতে। নাশতার টেবিলে চারটা কাগজ পড়ে থাকবে, যার যেটা ইচ্ছা উঠিয়ে নাও। তখন যদি কেউ প্রশ্ন করে, ব্যাপার কী? তখন না হয় বলা যাবে। মুহিব এখনো কাউকে কিছু বলতে পারছে না কারণ সে নিজেও চাকরির ব্যাপারে পুরোপুরি নিশ্চিত হতে পারছে না। তার মনে প্রবল সন্দেহ— এক তারিখে সে যখন জয়েন করতে যাবে তখন তাকে বলা হবে, সামান্য ভুল হয়েছে। পরে যোগাযোগ করুন।