বড় একটা কাচের গ্লাসে বিশেষ এক ধরনের শরবত বানানো হয়েছে। তার রঙ ঘন কালো। বিশেষ ধরনের শরবত প্রস্তুতের কাজটা সবসময় করে মহসিন। জিনিসটা বানানো হয় গোপনে। তাতে কী কী মিশানো হয় তাও গোপন। অতি সামান্য জিনিস দিয়েও মহসিন অসামান্য জিনিস বানিয়ে ফেলতে পারে। খেতে স্বাদু হয়। তারচে বড় কথা অতি অল্পতেই নেশা হয়ে যায়। শরবতের দিকে তাকিয়ে ইয়াকুব বলল, রঙ দেখে মনে হচ্ছে মারাত্মক হয়েছে। এই ড্রিংকের নাম দিলাম— শ্রীকৃষ্ণ। শ্রীকৃষ্ণ শরবত। মহসিন বলল, ঠাণ্ডা না হলে খেয়ে মজা পাওয়া যাবে না।
ঠাণ্ডা করার ব্যবস্থা করা যাচ্ছে না, কারণ সফিকের মামা ফ্রিজ তালাবন্ধ করে গেছেন।
সফিকের নির্দেশে তার দিয়ে খুঁচিয়ে অতি দ্রুতই ফ্রিজ খুলে ফেলা গেল। জিনিস ডিপ ফ্রিজে ঠাণ্ডা করতে দেয়া হলো। ইয়াকুব বলল, সফিক, তোর মামার এই বাড়িতে এসি আছে?
সফিক শঙ্কিত গলায় বলল, মামির শোবার ঘরে আছে। কেন?
এসি ছেড়ে দিয়ে ঐ ঘরে সবাই আড্ডা দিতাম। এসি ঘরের সুবিধা হলো হৈচৈ হলেও দরজা-জানালা টাইট করে বন্ধ থাকে, শব্দ বাইরে যায় না।
সফিক বলল, অসম্ভব! মামা-মামির শোবার ঘর খোলাই যাবে না। মামা যদি টের পায় আমাকে খুন করে ফেলবে।
হারুন বলল, নিজের মায়ের আপন ভাই তোকে খুন করে ফেলবে, কারণ তুই তার শোবার ঘরে কিছুক্ষণ বসে ছিলি?
কিছুক্ষণ তো তোরা বসবি না— একবার ঢুকলে ঐখানেই থাকবি।
হারুন বলল, খুব ভালোমতো চিন্তা করে দেখ, মহসিন যে শরবত বানিয়েছে ঐ শরবত খাবার পর অবশ্যই কিছু হৈচৈ হবে। আশেপাশের ফ্ল্যাটের লোক জানবে। তোর মামার কাছে খবর পৌঁছে যাবে। তারচে কি এসি ঘরে বসা ভালো না?
ঐ ঘর তালাবন্ধ। আমার কাছে চাবি নেই।
চাবি নেই, চাবির ব্যবস্থা হবে। ফ্রিজ যেভাবে খুলেছে ঐ ঘরের দরজাও সেইভাবে খুলে যাবে। চিচিং ফাঁক।
সফিক হতাশ গলায় বলল, যা ইচ্ছা কর। আসলে তোদের খবর দেয়াই ভুল হয়েছে। মিসটেক অব দা সেঞ্চুরি।
হারুন বলল, ভুল করবার জন্যেই তো মানুষ হিসেবে আমাদের জন্ম হয়েছে। আল্লাপাক চাচ্ছেন আমরা ভুল করি। এই জন্যেই আমাদের মানুষ বানিয়ে পাঠিয়েছেন। তিনি যদি চাইতেন আমার শুধু শুদ্ধ করি তাহলে আমাদের ফেরেশতা বানিয়ে পাঠাতেন। আমাদের ভুল করার কোনো উপায় থাকত না।
মহসিন বলল, ফেরেশতাও তো ভুল করে। শয়তান ফেরেশতা ছিল, সে ভুল করেছে। ভুলিয়ে ভালিয়ে গন্ধম খাইয়েছে। যার ফলে স্বর্গ থেকে পতন। এখন আমরা হা চাকরি হা চাকরি করছি।
হারুন বলল, শয়তান ফেরেশতা ছিল তোকে কে বলেছে? শয়তান ছিল জ্বিন।
মহসিন বলল, শয়তান জ্বিন ছিল এই খবর তোকে কে দিয়েছে? শয়তান এসে তোকে দিয়ে গিয়েছে? সারা জীবন শুনে এসেছি শয়তান ছিল ফেরেশতা। আদমকে সেজদা না করায় সে অভিশপ্ত। আর আজ তুই জ্বিনের থিওরি নিয়ে এসেছিস। একশ টাকা বাজি শয়তান ফেরেশতা।
হাজার টাকা বাজি শয়তান ফেরেশতা।
হাজার টাকা তোর কাছে আছে? তুই হাজারপতি কবে থেকে?
হাজার টাকা সঙ্গে নাই, তাই বলে এক হাজার টাকা জোগাড় করতে পারব না? আমি পথের ফকির?
জোগাড় করতে পারলে তো ভালোই আয় হাজার টাকা বাজি।
অবশ্যই।
মহসিন গম্ভীর গলায় বলল, আজ রাতের মধ্যেই ফয়সালা হবে। তুই যদি হাজার টাকা দিতে না পারিস তাহলে তুই নেংটো হয়ে চারতলা থেকে সিড়ি বেয়ে একতলায় দারোয়ানের ঘর পর্যন্ত যাবি। দারোয়ানকে ঘুম থেকে ডেকে তুলে বলবি, হ্যালো মিস্টার! তারপর আবার ফিরে আসবি।
মহসিনের হাত কাঁপছে। রেগে গেলে তার হাত কাঁপে।
হারুন শান্ত গলায় বলল, ওকে। তুই হারলে তোকেও এই কাজ করতে হবে। তোকেও গিয়ে দারোয়ানকে হ্যালো মিস্টার বলতে হবে।
বলব। আমার কোনো সমস্যা নেই। নো প্রবলেম। আমি রাজি।
আন্ডারওয়ার পরে দৌড় দিলে হবে না। নেংটা মানে নেংটা। পুরো নেংটা বাবা ভোম ভোম। নেংটা কুমার।
ওকে। নেংটা কুমার।
এসি ঘর খোলা হয়েছে। হাই কুলে দিয়ে ঘর ঠাণ্ডা করে ফেলা হয়েছে। মহসিনের বিশেষ শরবত সবাই দুকাপ করে খেয়েছে। জিনিসটার স্বাদ টকমিষ্টি। সফিক বলল, টেস্ট তো মারাত্মক হয়েছে। এর মধ্যে আছে কী?
মহসিন বলল, আছে কী তা দিয়ে দরকার কী? একশান হচ্ছে কি-না বল।
সফিক বলল, একশান হচ্ছে না। খেতে মজা লাগছে, কিন্তু নো একশান। খাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তো একশান হবে না। সময় লাগবে।
হারুন খাটে উঠে বসেছে। তার কোলে টেলিফোন। শয়তান ফেরেশতা নাকি জ্বিন–এই সমস্যা সমাধানের জন্যে সে নানান জায়গায় চেষ্টা চালাচ্ছে। সে এতই ব্যস্ত যে মহসিনের শরবত খাবার প্রতিও তার আগ্রহ নেই। হারুন বলল, রাতে ডিনারের কোনো ব্যবস্থা আছে?
সফিক বলল, না।
হারুন বলল, চান্দা তুলে কাউকে পাঠা, নানরুটি আর শিক কাবাব নিয়ে আসুক। পারহেড একটা শিক আর একটা নান। আমার পকেটে দশ টাকা আছে। আমি দিয়ে দিলাম। এই আমার সম্বল।
মহসিন বলল, দশ টাকা সম্বল আর তুই হাজার টাকার বাজি ধরেছিস?
হারুন বলল, বাজিতে তুই যদি জিতে যাস হয় তোকে হাজার টাকা দেব, আর নয় তো এখান থেকে নেংটো হয়ে বাসায় ফিরব।
রাত একটা দশ। পুরো দল ঝিমুচ্ছে। শিক কাবাব এবং নানরুটি এসেছে, কেউ কিছু মুখে দেয় নি। শুধু হারুন একাই পাঁচটা শিক এবং তিনটা নানরুটি খেয়ে ফেলেছে। সফিকের অবস্থা খুব খারাপ। সে পাঁচ-দশ মিনিট করে ঘুমাচ্ছে, আবার জেগে উঠছে। তার চোখ গাঢ় লাল।