হুঁ।
আসলে বন্ধু পাওয়াই ভাগ্যের ব্যাপার। বন্ধুত্বের বিষয়ে কবি ইয়েটস-এর কিছু লাইন আছে অসাধারণ–
Think where mans glory most begins and ends
And say, my glory was I had such friends.
লাইন দুটা সুন্দর না?
হুঁ।
মুখস্থ করে ফেল। মুখস্থ করে ফেললে সময়ে অসময়ে বলতে পারবি। আরেকবার বলি?
Think where mans glory most begins and ends
And say, my glory was I had such friends.
মিরপুর দুনম্বরের চারতলা ফ্ল্যাট বাড়ি
মিরপুর দুনম্বরের চারতলা ফ্ল্যাট বাড়ির ডানদিকের ফ্ল্যাটটায় (D4, দরজার পাশে টবে কামিনী ফুলের বড় একটা গাছ।) সফিক গত এক সপ্তাহ ধরে বাস করছে। ফ্ল্যাটের মালিক সফিকের মেজো মামা আব্দুল গফুর। তিনি স্বপরিবারে আজমীর শরিফে গিয়েছেন খাজা বাবার দোয়া নিতে। বিয়ের পনেরো বছর পরেও ছেলেমেয়ে হচ্ছে না। খাজা বাবার দরবার শরিফ থেকে স্বামী-স্ত্রী হাতে সুতা বেঁধে আসবেন। সুতা বাঁধার পর ইন্ডিয়াতে ঘুরবেন। তাজমহল-টাজমহল দেখবেন। তাদের এক মাসের পরিকল্পনা। সফিকের দায়িত্ব হলো, সে এক মাস বাড়ির দেখাশোনা করবে। কামিনী ফুলের গাছে পানি দেবে। ভেতরের বারান্দায় টবে পাঁচটা গোলাপ গাছ লাগানো হয়েছে। গোলাপ গাছে কলি দেখা দিলেই কাঁচি দিয়ে কলি কেটে ফেলবে। এতে নাকি পরবর্তীতে ফুল অনেক বড় হবে। আব্দুল গফুর সাহেব সফিকের হাতে বসার ঘর এবং রান্নাঘরের চাবি দিয়ে গেছেন। বাকি ঘরগুলি তালাবন্ধ করে গেছেন। সফিককে তিনি হাতখরচ হিসেবে এক হাজার টাকাও দিয়ে গেছেন। সফিক খুবই ব্ৰিত গলায় বলেছে— ছিঃ ছিঃ মামা, টাকা দিতে হবে কেন? অসম্ভব, টাকা তুমি রাখো তো।
সফিকের মামা বলেছেন, বেকার মানুষ, তোর টাকা লাগবে না? পকেটখরচ হিসেবে রেখে দে। আর শোন, চব্বিশ ঘণ্টা বাড়িতে থাকতে হবে তা-না। রাতে গিয়ে শুধু ঘুমালেই হবে। সোফাতে শুয়ে থাকবি। ফুল স্পিডে ফ্যান ছেড়ে দিলে মশা ধরবে না। মশার কয়েল জ্বালাবি না। নতুন কার্পেট কিনেছি। কার্পেট পুড়ে-টুরে যেতে পারে।
মশা কামড়ে খেয়ে ফেললেও আমি মশার কয়েল ধরাব না। কয়েলের গন্ধে আমার মাথা ধরে যায়।
রান্নাঘরে ঢুকে রান্নাবান্নার চেষ্টা যেন আবার করিস না। বেসিন নোংরা করে রাখবি, তোর মামি রাগ করবে।
আমি খাওয়া-দাওয়া করেই বাড়িতে ঢুকব। তুমি মোটেই চিন্তা করবে না।
বন্ধু-বান্ধব জমিয়ে আড্ডা দিস না যেন।
আরে না। রাত আটটা সাড়ে আটটার দিকে টুক করে বাড়িতে ঢুকব। ভোরবেলা বের হয়ে আসব। বন্ধু-বান্ধবকে এই বাসার খবরই দেব না। সিগারেট খেয়ে তারা যেখানে-সেখানে ছাই ফেলবে। দরকার কী!
বের হয়ে আসার সময় ভালোমতো তালা দিবি। তালা লাগাবার পর ভালোমতো টেনে টেনে দেখবি ঠিকমতো লাগল কি-না।
অবশ্যই।
ফুলগাছে পানি ঠিকমতো দিবি। গোলাপ গাছগুলিতে একদিন পর পর। কামিনী গাছে রোজ দিতে হবে। আজমীরে যাচ্ছি, তোর জন্যেও দোয়া করব। খাজাবাবার কাছ থেকে খালি হাতে কেউ ফিরে না। দেখবি বছর না ঘুরতেই চাকরি হবে ইনশাল্লাহ।
দুই-তিন গজ সুতা নিয়ে এসো। নিজে পরব, বন্ধু-বান্ধবকে দেব।
প্রথম দিনেই সন্ধ্যার পর থেকে সফিকের বন্ধু-বান্ধবরা জড়ো হতে শুরু করল। সফিক মাত্র দুজনকে খবর দিয়েছিল। সেই দুজন বাকিদের খবর দিয়েছে। রাত নটার মধ্যে সফিকের আট বন্ধু এসে উপস্থিত হয়ে গেল।
বসার ঘর ছোট। আটজনের আরাম করে বসা সম্ভব না। সোফা বের করে বারান্দায় নিয়ে যাওয়া হলো। এখন কার্পেটের উপর আরাম করে পা ছড়িয়ে বসে আড্ডা দেয়া যায়। সফিক বলল, রাত এগারোটার মধ্যে আড্ডা শেষ। এগারোটা বাজার এক মিনিট পরে যেন আমি কাউকে দেখতে না পাই। এটা কোনো অনুরোধ না। আদেশ। আরেকটা কথা এখানে যতক্ষণ থাকবি ফিসফিস করে কথা বলবি। কথার শব্দ যেন এক দেড় ফুটের বাইরে না যায়।
সফিকের অতি ঘনিষ্ঠ বন্ধু ইয়াকুব বলল, ফিসফিস করে কথা বলতে হবে কেন?
এটা ফ্ল্যাটবাড়ি, এখানে হৈচৈ করা যাবে না। ঘটনা ঘটানো যাবে না।
ইয়াকুব অবাক হয়ে বলল, এখনো তো কোনো ঘটনাই ঘটে নি। তুই রেগে যাচ্ছিস কেন?
সফিক বলল, ঘটনা ঘটে নি কিন্তু তোরা ঘটনা ঘটাবি— এই জন্যে এডভান্স রেগে যাচ্ছি।
ইয়াকুব বলল, জগতের নিয়ম হলো প্রথমে Cause তারপর Effect. তোর তো দেখি উল্টা, প্রথমে Effect তারপর Cause। ঠিক আছে, এত চেচেতির দরকার নাই। আমরা চলে যাই।
চলে যা, কাউকে আমি পায়ে ধরে সেধে আনি নি।
ইয়াকুব বলল, তুই বরং এক কাজ কর, তিনটা সিডাকসিন ট্যাবলেট খেয়ে ঝিম ধরে সোফায় শুয়ে থাক। আমরা আড্ডা দেই। মামা হিল্লি-দিল্লি করে বেড়াচ্ছে। তার ভয়ে তুই কেঁচোরও অধম হয়ে গেলি। তোর সামনে এখন কেঁচোও আলেকজান্ডার দি গ্রেট।
বক্তৃতা দিবি না।
আমরা থাকব, না চলে যাব— স্ট্রেইট বল। হাংকি পাংকি না।
চলে যেতে বলেছি?
ভাব বাচ্যে কথা বলবি না। হয় ইয়েস কিংবা নো।
তোদের থাকতে ইচ্ছা হলে থাকবি। চলে যেতে চাইলে চলে যাবি।
এত কথার দরকার নাই–চলে যাচ্ছি।
ঠিক আছে, যা চলে যা।
রাত এগারোটার সময় দেখা গেল কেউই যায় নি। বরং আরো দুজন এসে যুক্ত হয়েছে। সফিককে সবচে আনন্দিত মনে হচ্ছে। সে চোখ বন্ধ করে তার অতি প্রিয় সঙ্গীত গাইছে–আমরা পুতুলওয়ালা, পুতুল বেচে যাই…। সফিকের গানের গলা নেই। কেউ গান গাইলে সে বিরক্ত হয়। কিন্তু নিজে গভীর আবেগে ভুল তালে ভুল সুরে পুতুলওয়ালা গান গায়। তখন কেউ যদি কোরাসে অংশ নেয় সে অত্যন্ত আনন্দিত হয়। তাকে আনন্দ দেয়ার জন্যে অনেকেই তার সঙ্গে গলা মেলায়।