মুহিব বাথরুম থেকে বের হয়েছে। সে যে শুধু হাত-পা ধুয়েছে তা না, মাথায়ও পানি দিয়েছে। চুল বেয়ে পানি পড়ছে। শামসুদ্দিন ছেলের দিকে তাকিয়ে খুশিখুশি গলায় বললেন, কাছে আয় মাথা মুছিয়ে দেই। মুহিব আপত্তি করল না। এবার কাছে এগিয়ে গেল। শামসুদ্দিন নিচু গলায় বললেন, চাকরি হচ্ছে কি হচ্ছে না— এই নিয়ে চিন্তা করে মাথা খারাপ করবি না। যখন হবার হবে। ভাগ্যে যা থাকার তাই হয়।
মহিব বলল, তুমি কি নতুন বাড়ি খুঁজে পেয়েছ? এই বাড়ি ছেড়ে দিতে হবে বলেছিলে।
শামসুদ্দিন সাহেবের আবার খানিকটা মন খারাপ হলো। ছেলে তাকে নিয়ে দুশ্চিন্তা করছ। বেচারার নিজের ঝামেলারই কোনো পারাপার নেই, তাকে ভাবতে হচ্ছে অন্যের ঝামেলা নিয়ে।
শামসুদ্দিন সাহেব মিথ্যা করে বললেন, এখনো খোঁজা শুরু করি নাই। তাছাড়া লোকজনদের বলা আছে। খুঁজতেও হবে না। তাছাড়া আমি একা মানুষ, আমার কিছু লাগবে না। একা মানুষের জন্যে কিছু লাগে না। কথায় আছে—
ভোজনং যত্রতত্র
শয়নং হট্ট মসজিদ।
মুহিব বুলি, কথাটা হবে হট্ট মন্দির। তুমি মসজিদ বলছ কেন?
এখানে মন্দির পাব কোথায়। আর যদি পাইও ওরা কি মন্দিরে আমাকে ঘুমাতে দিবে?
তুমি কি আজকাল ধর্ম-কর্ম করছ?
দাড়ি দেখে বলছিস? ফজর আর মাগরেবের নামাজটা পড়ার চেষ্টা করি।
মুহিব হঠাৎ বলে বসল, বাবা, তুমি কি খুব কষ্টে আছ?
কথাটা মুহিব খুব স্বাভাবিকভাবে বলল, কিন্তু শামসুদ্দিনের চোখে সঙ্গে সঙ্গে পানি এসে গেল। গলা ভারী হয়ে গেল। তিনি অবহেলার একটা ভাব চোখেমুখে এনে বললেন, কষ্টে আছি তোকে কে বলল? সুখে আছি বুঝলি। সংসারের টেনশন মাথায় নাই। রাতে যখন ইচ্ছা শুয়ে পড়লাম, আবার ইচ্ছা করল সারা রাত বসে রইলাম। কারো কিছু বলার নেই। Freedom-এর আনন্দের কাছে সব আনন্দ তুচ্ছ। এই বিষয়ে কোলরিজের একটা বিখ্যাত বাক্য আছে। মনে পড়লেই তোকে বলব। আজকাল স্মৃতিশক্তি দুর্বল হয়ে গেছে।
মুহিব ফট করে বলে বসল, বাবা, যমুনা মেয়েটা কোথায়? যার জন্যে তুমি আমাদের সবাইকে ফেলে রেখে চলে এলে। যে মেয়ের জন্যে তুমি এতটা করলে সে তোমাকে এই অবস্থায় রেখে চলে গেল কেন?
শামসুদ্দিন খুবই বিব্রত বোধ করছেন। ছোটবেলায় মুহিবের অভ্যাস ছিল বাবার বুকের উপর শুয়ে ঘুমানো। সেই ছেলে এমন কঠিন প্রশ্ন করছে!
মুহিব বলল, তোমার জবাব দিতে ইচ্ছা না হলে জবাব দিও না। চা বানাও চা খাই।
শামসুদ্দিন চা বানালেন। ঘরে দুধ নেই, লিকার চা। তিনি ছেলের দিকে তাকিয়ে খুশি খুশি গলায় বললেন, আদা-চা বানিয়ে দিলাম। খেয়ে দেখ, শরীর ঝরঝরে হয়ে যাবে। কোরান শরীফে আদার রেফারেন্স আছে এটা জানিস?
না।
আল্লাহপাক বলেছেন, বেহেশতে তোমাকে দেয়া হবে আদা মিশ্রিত পানীয়। আল্লাহপাক আদা-চায়ের কথাই বলেছেন কি-না কে জানে।
বাবা, তোমার শরীর কিন্তু খুবই খারাপ করেছে। চোখ ফুলে গেছে। হাতপা ফুলে গেছে। শরীরে মনে হয় পানি এসেছে।
বুড়ো বয়সে শরীরে পানি তো আসবেই। আমার তো তাও কম এসেছে। অনেকের এমন পানি আসে যে শরীরেই জোয়ার-ভাটা হয়। হা হা হা হা।
মুহিব তাকিয়ে আছে। শামসুদ্দিন সাহেব হেসেই যাচ্ছেন। অনেক কষ্টে হাসি থামিয়ে বললেন, তোর বন্ধু-বান্ধবরা কেমন আছে?
কোন বন্ধুরা?
ঐ যে কিছু বেকার বন্ধুরা ক্লাবের মতো কী যেন করেছিস।
ক্লাব-টাব কিছু না। মাঝে মাঝে এক সঙ্গে বসা হয়।
ওরা আছে কেমন?
ভালো।
একজনকে নিয়ে এসেছিলি, সফিক নাম।
জি।
সফিক ভালো আছে?
জি, ভালো আছে।
অসাধারণ ছেলে। এমন ভালো ছেলে আমি আমার জীবনে দেখি নি।
কোন অর্থে ভালো ছেলে?
সব অর্থে। তাকে একবার কথায় কথায় বলেছিলাম, ঢাকা শহরে ভালো ঘি পাওয়া যায় না। সবই ভেজাল। সে বলল, চাচাজি, আমি শেরপুর থেকে আসল সরে ভাজা ঘি এনে দেব। এই ধরনের কথার কথা তো সবাই বলে। কয়জন আর মনে রাখে! সফিক কিন্তু ঠিকই মনে রেখেছে। এক কেজি ঘি এনে দিয়েছে যেমন ঘ্রাণ, খেতেও তেমন সুস্বাদু। এখনো আছে। এক চামচ খাবি?
শুধু শুধু ঘি খাব কেন?
শুধু শুধু খাওয়া যায়। মাঝে মাঝে শরীর ভালো থাকে না। রান্নাবান্না করতে ইচ্ছা করে না। আমি করি কী, দুই চামচ ঘি আর দুই গ্লাস পানি খেয়ে শুয়ে পড়ি। দেব তোকে এক চামচ? লবণের ছিটা দিয়ে খেয়ে দেখ। অবশ্যই ভালো লাগবে। দেব?
মুহিব বলল, দাও।
মুহিব ঘণ্টাখানেক সময় কাটিয়ে ঘর থেকে বের হলো।
শামসুদ্দিন সাহেব ছেলেকে এগিয়ে দিতে গেলেন। নিজেই রিকশা ঠিক করলেন। দরদাম করে ভাড়া কমিয়ে ভাড়া দিয়ে দিলেন। রিকশা যখন চলতে শুরু করল তখন হঠাৎ বললেন, মুহিব দাঁড়া। তোর সঙ্গে রিকশায় করে কিছু দূর যাই। এ জার্নি বাই রিকশা। আমার খারাপ লাগে না। হাওয়া খেতে খেতে যাওয়া। শহরের বিষাক্ত হাওয়া— এইটাই যা সমস্যা।
রিকশা চলছে। শামসুদ্দিন ছেলের পাশে বসে আছেন। এক সময় ইতস্তত করে বললেন, তোর কি সিগারেট খাওয়ার অভ্যাস আছে?
মুহিব বলল, না।
শামসুদ্দিন সাহেব বললেন, যদি অভ্যাস থাকে তাহলে আমাকে লজ্জা করিস। একটা বয়সের পর পুত্র হলো মিত্র বদাচারে অর্থাৎ মিত্র। তোর বন্ধুরা তোর কাছে যেমন, আমিও সে-রকম। বুঝতে পারছিস?
হুঁ।
তোর বন্ধু সফিকের সঙ্গে তোর কি আজ দেখা হবে?
হুঁ।
দেখা হলে অবশ্যই বলবি তার দেয়া ঘি আমি খুব আরাম করে খেয়েছি। বলতে পারবি না?
হুঁ।
সফিকের মতো ছেলে বন্ধু হিসাবে পাওয়া ভাগ্যের কথা।