কেন?
উনাকে বাড়ি থেকে বের করে দেয়া হয়েছে। উনি এখন আর আমাদের পরিবারের সদস্য না।
বলতে বলতে মুহিব আরাম করে ঘুমিয়ে পড়ল।
মুহিবের বাবা শামসুদ্দিন সাহেব
মুহিবের বাবা শামসুদ্দিন সাহেব পল্লবীতে থাকেন। দুই কামরার ঘর, পেছনে বারান্দা আছে। টিনের ছাপড়া দিয়ে বারান্দা ঢাকা। সেখানেই রান্নার ব্যবস্থা। গ্যাসের কারবার নেই, রাধতে হয় কেরোসিনের চুলায়। সেটা শামসুদ্দিন সাহেবের জন্যে কোনো ব্যাপার না। তিনি একা মানুষ বিশাল বাড়ি দিয়ে তিনি কী করবেন! তার দরকার ঘুমাবার জন্যে একটা জায়গা। মাথার উপর ফ্যান। (তিনি গরম একেবারেই সহ্য করতে পারেন না। শীতের সময়ও ফ্যান ছেড়ে রাখতে হয়।)
তাঁর জন্যে সবচে সুবিধা হতো যদি এক কামরার একটা ঘর হতো। ঘরের এক কোনায় রান্নার ব্যবস্থা থাকবে। টুক করে পানি গরম করে এক কাপ চা খেয়ে ফেলা। এক মুঠ চাল এক মুঠ ডাল দিয়ে খিচুড়ি। রান্নার শেষ পর্যায়ে চায়ের চামচে এক চামচ ঘি। ব্যস ফুরিয়ে গেল।
এক কামরার একটা ঘরই তার জন্যে যথেষ্ট ছিল। এখন যে বাড়িতে আছেন সেটাও খারাপ না। ফ্ল্যাট বাড়ি না। আলাদা বাড়ি। মাথার উপর টিনের ছাদ। রাতে টিনের চালে যখন বৃষ্টি হয় অদ্ভুত ভালো লাগে। জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত এই বাড়িতে থাকতে পারলে খারাপ হতো না। সেটা সম্ভব হচ্ছে না। বাড়ি ছেড়ে দিতে হবে। খুপড়ি খুপড়ি টিনের বাড়ি সব উঠে যাচ্ছে। বিশাল অ্যাপার্টমেন্ট কমপ্লেক্স হবে। লিফট থাকবে। আলাদা জেনারেটর থাকবে। সব ভাড়াটেদের বাড়ি ছাড়ার নোটিশ দেয়া হয়েছে। বাড়ি ছাড়ার শেষ সময়ও পার হয়ে গেছে। বেশির ভাগই চলে গেছে। শামসুদ্দিন সাহেব যেতে পারেন নি। তিনি বাড়ি খুঁজে পাচ্ছেন না। বৃদ্ধদের কেউ বাড়ি ভাড়া দিতে চায় না। বাড়িওয়ালা চোখ বড় বড় করে বলে, একা থাকবেন? আপনার ফ্যামিলি মেম্বাররা কোথায়?
তারা ঢাকায়। তাদের সাথে আমার ঠিক অ্যাডজাস্টমেন্ট হয় না বলে আমি আলাদা থাকি।
অ্যাডজাস্টমেন্ট হয় না কেন?
শামসুদ্দিন সাহেব ধাঁধায় পড়ে যান। কী জবাব দেবেন বুঝতে পারেন না। অ্যাডজাস্টমেন্ট কেন হয় না— এটা তার ব্যক্তিগত ব্যাপার। এটা নিয়ে বাড়িওয়ালার সঙ্গে আলাপ করার কিছু নেই। ব্যাপারটা পুরোপুরি ব্যাখ্যা না করলে বাড়ি পাওয়াও যাবে না। বাড়িওয়ালাকে সন্তুষ্ট করতে হবে।
আপনি করেন কী? মানে আপনার সোর্স অব ইনকাম কী?
কোচিং সেন্টারে পড়াই।
কী পড়ান?
ইংরেজি পড়াই। আমি একটা বেসরকারি কলেজের ইংরেজির শিক্ষক ছিলাম। রিটায়ার করেছি।
আপনি যে একা থাকবেন অসুখ-বিসুখ হলে আপনাকে দেখবে কে?
মেজাজ খারাপ হবার মতো প্রশ্ন। আমাকে কে দেখবে সেটা আমার ব্যাপার। তোমার মাসে মাসে ভাড়া পেলেই তো হলো।
বাড়িওয়ালাকে এই ধরনের কথা বলা যায় না। বাড়ি ভাড়া নেবার আগে বাড়িওয়ালার মন জুগিয়ে কথা বলতে হয়। স্রোতের পাংগাশ হতে হয়। স্রোত যেদিকে পাংগাশ মাছ সেদিকে। বাড়িওয়ালা স্রোত, ভাড়াটে পাংগাশ।
শামসুদ্দিন সাহেব যথেষ্টই ঝামেলায় পড়েছেন। কেউ তাকে বাড়ি ভাড়া দেবে— এরকম মনে হচ্ছে না। শেষপর্যন্ত হয়তো সস্তা ধরনের কোনো হোটেলে মাসকাবারি বন্দোবস্তে যেতে হবে। এটাও খারাপ না। হোটেলে থাকা মানেই লোকজনের মধ্যে থাকা। বয়-বাবুর্চির আনাগোনার মধ্যে থাকা। কোথাও টেলিফোনের দরকার পড়ল— ম্যানেজারের অফিস থেকে টেলিফোন। শরীরও এখন ভালো যাচ্ছে না। কথা নেই বার্তা নেই হুট করে রাতদুপুরে একশ দুই একশ তিন জ্বর। এ ধরনের পরিস্থিতিতে বয়কে খবর দিলে মাথায় এসে পানি ঢালবে। পাঁচ-দশ টাকা বকশিশ ধরিয়ে দিলেই হলো।
তিনি হোটেল খোজা এখনো শুরু করেন নি। রোজই ভাবেন আগামীকাল থেকে শুরু হবে। ইত্তেফাঁক পত্রিকায় ছয়শ টাকা খরচ করে একটা বিজ্ঞাপন দিয়েছেন। তাতে কিছু হয় কি-না সেটা দেখে জোরেসোরে হোটেলে ঘর খোজা শুরু করবেন। ইত্তেফাঁকের বিজ্ঞাপনটা এরকম–
লজিং চাই
ইংরেজি ভাষা ও সাহিত্যের অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক।
থাকা-খাওয়ার বিনিময়ে লজিং চাই।
এখনো কোনো জবাব আসে নি। ঢাকা শহরের লোকজন ছেলেমেয়েদের প্রাইভেট পড়ানোর ব্যাপারে আগ্রহী, তবে ঘরে টিচার রাখতে আগ্রহী না। ঘরে লজিং রাখার ব্যাপার মনে হয় ঢাকা শহরের লোকজন ভুলে গেছে। লজিং শব্দটা এসেছে Lodge থেকে।
তাড়াতাড়ি কোনো একটা লজিং-এর ব্যবস্থা হলে ভালো হয়। কারণ কোচিং সেন্টারে কিছু সমস্যা হয়েছে। কোচিং সেন্টারের মালিক চেংড়া এক ছেলে মাসখানেক আগে তাকে ডেকে নিয়ে মুখ-চোখ কুঁচকে বলল— শামসুদ্দিন সাহেব, আপনি দাড়ি রেখেছেন কেন? এখন তো আপনাকে দেখে মনে হয় মাদ্রাসার শিক্ষক। ছাত্রদের পড়াবেন ইংরেজি, গেটাপে স্মার্টনেস থাকবে। মুখভর্তি যদি মওলানার মতো দাড়ি থাকে তাহলে চলবে কীভাবে? আজ দাড়ি রেখেছেন, পড়শু থেকে ধরবেন লম্বা আচকান। তারপর চোখে দেবেন সুরমা। কয়েক দিন পরে মাথায় বেতের গোলটুপি। ভাই, আমরা তো ব্যবসা করতে এসেছি। আমাদের শো-শা থাকতে হবে। থাকতে হবে না?
শামসুদ্দিন বললেন, জি থাকতে হবে।
ব্যক্তিগতভাবে আপনি যত ইচ্ছা ধর্মকর্ম করেন। আমার কোনো সমস্যা নাই। আমি নিজে পাঁচওয়াক্ত নামাজ পড়ার চেষ্টা করি। দুবছর আগে ওমরা হজ করে এসেছি। বুঝতে পারছেন কী বলার চেষ্টা করছি?
কিছু না বুঝেই শামসুদ্দিন সাহেব বললেন, জি বুঝতে পারছি।