কুসুম আপু ভাইয়ার চোখের পানি সম্পূর্ন অগ্রাহ্য করে বিছানায় বসতে বসতে বলল, তারপর ফেল কুমার, ইংরেজি রচনা কয়টা মুখস্ত হয়েছে?
একটা।
কোনটা, A Village Fair?
হুঁ।
পুরোপুরি মুখস্থ হয়েছে?
একটু বাকি আছে।
তোমার কাছ থেকে শুনে শুনে A Village Fair রচনা এ বাড়ির সবার মুখস্থ হয়েছে। একশ টাকা বাজি টগরও এই রচনা মুখস্থ বলে দেবে। আমাদের বাসায় যে কালো একটা বিড়াল আসে। ঐ বিড়ালটারও রচনাটার প্রথম ছয় লাইন মুখস্থ।
তোর ফালতু কথা শেষ হয়েছে? কথা শেষ হলে যা।
ফালতু কথা শেষ হয়েছে। কাজের কথা বাকি আছে।
কাজের কথাটা কী?
তুমি আমার চুল কেটে দিতে পারবে? লম্বা চুলের জন্যে গরম লাগে ঘুমাতে পারি না। গোসল করলে চুল শুকায় না বিশ্রী লাগে।
এত সুন্দর লম্বা চুল কেটে ফেলবি?
হুঁ কেটে ফেলব।
ভাইয়া বই বন্ধ করে কুসুম আপুর দিকে তাকাল এবং শান্ত গলায় বলল, কুসুম তুই ঢং করছিস কেন? চুল তুই কোনোদিন কাটবি না। লম্বা চুল তোর নিজের খুব পছন্দের। ঢং করার দরকার কী?
ঢং করছি না। আমি আজ রাতেই চুল কাটব। তুমি কেটে না দিলেও আমার কেটে দেবার লোক আছে। টগর কেটে দেবে। কি রে টগর চুল কেটে দিবি না?
আমি বললাম, না।
কুসুম আপু বলল, আমার চোখের দিকে তাকিয়ে না বল। অন্য দিকে তাকিয়ে না বলছিস কেন?
আমি কুসুম আপুর চোখের দিকে তাকিয়ে না বলতে যাব তার আগেই রহিমা ফুপুর কাশির শব্দ শোনা গেল। এই কাশির অর্থ তিনি জেগে আছেন। মেয়ে কোথায় যাচ্ছে কী করছে খেয়াল রাখছেন। কেশে কেশে তিনি মেয়েকে অনুসরণ করেন।
কুসুম আপু দরজার দিকে তাকিয়ে গম্ভীর গলায় বলল, কাশছ কেন মা? ফুপু ক্ষীণ গলায় বললেন, কাশ হয়েছে।
কুসুম আপু বলল, তোমার সর্দি কাশি কিছুই হয় নি। তুমি আশে পাশেই আছ এটা জানান দেবার জন্যে তুমি কাশছ। পাহারা দেবে না মা। খবর্দার পাহারা দেবে না। যাও ঘুমাতে যাও। যাও বললাম।
চিৎকার করিস না। তোর ফুপুর ঘুম ভেঙ্গে যাবে।
তুমি যদি দরজার পাশ থেকে না যাও আমি এমন চিঙ্কার দেব যে বাজার থেকে লোক ছুটে আসবে।
যাচ্ছি, তুই সব সময় এরকম করিস কেন?
কুসুম আপু বিছানা ছেড়ে উঠে দাঁড়াল। খপ করে আমার হাত ধরে বলল, এই টগর আমার সঙ্গে আয় তো।
আমি ভীত গলায় বললাম, কোথায় যাব?
আমি যেখানে নিয়ে যাব সেখানে যাবি।
ভাইয়া আমার দিকে তাকিয়ে ভীত গলায় বলল, যেতে বলছে যা। এমন শক্ত হয়ে বসে আছিস কেন?
কুসুম আপু আমাকে নিয়ে তার নিজের ঘরে ঢুকল। ভেতর থেকে দরজার ছিটকিনি দিয়ে দিল। আমি লক্ষ করলাম তার শরীর কাঁপছে। নিশ্চয় রাগে কাঁপছে। এত রাগ করার মতো কোনো ঘটনা তো ঘটে নি। কুসুম আপু আমার দিকে তাকাল। হাসল। তারপর খুবই স্বাভাবিক গলায় বলল, টেবিলের ড্রয়ারে একটা কাঁচি আছে। কাঁচিটা নিয়ে আমার চুল কেটে দে। কচকচ করে কাটবি। চুল কাটার কচকচ শব্দ শুনতে খুব ভালো লাগে। পারবি না?
আমি ভীত গলায় বললাম, পারব না।
অবশ্যই পারবি। আমি যা বললাম তোকে শুনতে হবে।
শুনতে হবে কেন?
কারণ আমি কোনো সাধারণ মেয়ে না। আমার শরীরে একটা বিশেষ চিহ্ন আছে। এই চিহ্ন যে সব মেয়েদের থাকে পৃথিবীর সব পুরুষরা তাদের কথা শুনে।
বিশেষ চিহ্নটা কী?
বুকের ঠিক মাঝামাঝি জায়গায় একটা লাল তিল। দেখতে চাস?
আমি কিছু বললাম না। চোখ নামিয়ে নিলাম। কুসুম আপুর চোখের দিকে তাকিয়ে থাকতে লজ্জা লাগছে।
মুখে না বললেও তুই যে দেখতে চাস এটা আমি তোর চোখ দেখেই বুঝতে পারছি। আচ্ছা যা তোকে তিলটা দেখাব। আজ না। অন্য আরেকদিন। কিন্তু খবর্দার, শুধু তিলটাই দেখবি। অন্যকিছু দেখবি না। অন্য কোনো দিকে যদি চোখ যায় তাহলে আমি কিন্তু কুরুশ কাটা দিয়ে তোর চোখ গেলে দেব। নে এখন আমার চুল কাটতে শুরু কর। খবর্দার হাত কাঁপাবি না।
কুসুম আপু কাঁচি এনে আমার হাতে দিল। আমি চুল কাটছি। বন্ধ দরজার ওপাশ থেকে রহিমা ফুপু বলছেন, দরজা বন্ধ কেন? এই কুসুম দরজা বন্ধ কেন? দরজা বন্ধ করে তুই কী করছিস?
যে সুন্দর সে সব সময়ই সুন্দর। মাথা ভর্তি চুল থাকলেও সুন্দর, চুল না থাকলেও সুন্দর। চুল কাটার পর কুসুম আপুকে কী সুন্দর যে লাগছে। আমি তাকিয়ে থাকি আর অবাক হই। কুসুম আপুর মুখ আগে লম্বা টাইপ ছিল। চুল কাটার পর মুখটা গোল হয়ে গেছে। চোখগুলি হয়ে গেছে টানা টানা। আমার ধারণা সবার কাছেই কুসুম আপুকে সুন্দর লাগছে। শুধু রহিমা ফুপুর লাগছে না। তিনি মেয়ের দিকে তাকালেই মুখ কাঁদো কাঁদো করে বলেন—মেয়েটাকে বান্দরের মতো লাগছে। ছিঃ ছিঃ কী সর্বনাশ। দুই দিন পরে আমি মেয়ের বিয়ে দিব। কোমর পর্যন্ত চুল আসতে লাগবে দশ বছর। আমার কী সর্বনাশ হয়ে গেল।
কুসুম আপু তার উত্তরে ঝগড়া করে না। খিল খিল করে হাসে এবং বলে, তোমার সর্বনাশ হবে কেন। আমার বিয়ে না হলে আমার সর্বনাশ। তোমার কী?
চুল ছোট করার পর কুসুম আপুর রাগও মনে হয় পড়ে গেছে। পড়ায় মন বসেছে। এখন আর ভাইয়ার সঙ্গে ঝগড়া করে না। রাতে বৃষ্টি নামলে অদ্ভুত গোসলও করে না। অনেক রাত পর্যন্ত দরজা বন্ধ করে পড়াশোনা করে। দরজা বন্ধ থাকে বলে রহিমা ফুপু ঘুমাতে যেতে পারেন না। বারান্দায় চৌকির উপর বসে থাকেন। হঠাৎ হঠাৎ মা তাকে তার ঘরে ডেকে নিয়ে যান। খুব নিচু গলায় দুজনের মধ্যে কথা হয়। নিশ্চয়ই বিশেষ কোনো কথা, কারণ তাদের কথা শেষ। হবার পর রহিমা ফুপু ঘর থেকে কাঁদতে কাঁদতে বের হন। মা নিজেও কাঁদতে থাকেন। এবং হুট করে তাঁর আধকপালী মাথা ব্যথা শুরু হয়। মা কাউকে। চিনতে পারেন না।