কে বলেছে আপনাকে?
সে নিজেই বলেছে। প্রথম দিকে পুলাটারে বড়ই ভয় পাইতাম। পরে চিন্তা করলাম ভয় পাইয়া আমার লাভটা কী? এখন তার সাথে টুকটাক কথা হয়।
সত্যি?
আমি কি তোমার সঙ্গে মিথ্যা বলতেছি? তোমার সাথে মিথ্যা বললে আমার ফয়দা কী? মিথ্যা কইলে আমার বেতন পঞ্চাশ টেকা বাড়ব না ডিউটি কমবে?
ছেলেটার সাথে কী কথা হয়?
বললাম না, টুকটাক কথা। সেও কম কথা কয়, আমিও কম কথা কই। অধিক কথা বলার তো কোনো সার্থকতা নাই।
ছেলেটার নাম কী?
নাম জিজ্ঞেস করেছিলাম। নাম বলে না। নাম জিগাইলে খলবলাইয়া হাসে।
আর কী করে?
ভেংচি দেয়। পুলাপাইন্যা ভেংচি। মইরা সে ভূত হইছে কিন্তুক পুলাপাইন্যা স্বভাব যায় নাই। পুলাপান ভূত। রেল লাইনের পাথর ঢিল দিয়া নদীতে ফেলে। রেল কোম্পানির ক্ষতি, আমি আবার সেই কোম্পানির নোকর। শেষে একদিন দিলাম ধমক। বললাম, পাথর ফেলবা না এতে লাইন দুর্বল হয়।
ধমক শুনে সে কী করল?
পাথর ফেলেন বন্ধ করছে। আসল কথা হইল বুঝাইয়া বলা। মানুষের যেমন বুঝাইয়া বললে শুনে, ভূত প্রেতরেও বুঝাইয়া বললে শুনে।
মানুষের মাথা হঠাৎ আউলা হয় না। আস্তে আস্তে আউলা হয়। আব্দুর রহমান চাচার মাথা আউলা হতে শুরু করেছে। কোন একদিন পুরোপুরি আউলা। হয়ে যাবে। তখন ভয়ংকর কিছু ঘটবে।
বাবার ধারণা সব মানুষের মাথায় আউলা গাছের বীজ পোঁতা থাকে। সেই বীজ থেকে ছোট্ট চারা বের হয়। চারা বের হওয়া মাত্র গাছ উপড়ে ফেলে দিতে হয়। অনেকেই সেটা করে না। তারা নানান যত্ন আত্তি করে। চারা গাছ দেখতে দেখতে বড় হয়ে যায়। তারা আউলা হয়ে যায়। আউলা গাছের বীজেরও আবার নানান ধরণ। কোনো কোনো বীজ থেকে আদর যত্ন ছাড়াই চারা হয়। দেখতে দেখতে সেই চারা গাছ ডালপালা ছড়িয়ে ঝাকড়া গাছ হয়ে যায়।
টগর বুঝলি খুব সাবধান। আউলা গাছের বীজ থেকে চারা গজাচ্ছে কি না খেয়াল রাখবি। শুধু নিজেরটা খেয়াল রাখলে হবে না। অন্যেরটাও খেয়াল। করতে হবে। তোর কি মনে হয় এই বাড়ির কারো কারো মাথায় আউলা গাছের বীজ আছে?
কুসুম আপুর মাথায় আছে।
বুঝলি কী করে?
আমার মনে হয়।
প্রমাণ ছাড়া এইভাবে কথা বলা ঠিক না। তোর কাছে প্রমাণ আছে রে ব্যাটা?
না।
বাবাকে যদিও বলেছি প্রমাণ নেই—আসলে কিন্তু আছে। যে রাতে ঝুম বৃষ্টি হবে সেই রাতে কুসুম আপু অবিশ্যিই ভেতরের বারান্দায় গোসল করবে। সেই গোসল খুবই রহস্যময়। কারণ কুসুম আপু যখন গোসল করে তখন রহিমা ফুপুর চাপা কাঁদো কাঁদো গলা শোনা যায়, ছিঃ কুসুম। ছিঃ।
কুসুম আপু শান্ত গলায় বলে, এত ছিঃ ছিঃ করবে না। ছিঃ বলার মতো কিছু করছি না।
রহিমা ফুপু বলেন, কী কেলেংকারী! কেউ যদি দেখে।
অন্ধকারে দেখবে কী করে? মানুষের চোখে কি টর্চ লাইট ফিট করা?
তখন রহিমা ফুপুর সত্যিকার কান্না শোনা যায়। রহিমা ফুপু কাঁদেন, কুসুম আপু তাঁকে চাপা গলায় ধমকান।
খবরদার মা। ফিঁচফিঁচ করবে না। যদি এরকম ফিঁচফিঁচ কর তাহলে ভিতরের বারান্দায় গোসল না করে বাইরে গোসল করব। সত্যি করব।
ফুপুর কান্না থেমে যায়।
যে সব মেয়ের মাথায় আউলা গাছের বীজ থেকে চারা হয়ে গেছে শুধু তারাই এমন রহস্যময় গোসল করতে পারে।
কুসুম আপু এ বছর পরীক্ষা দিচ্ছে কিন্তু দেখে মনে হয় না পড়াশোনা খুব হচ্ছে। তার প্রধান কাজ ভাইয়াকে বিরক্ত করা। ভাইয়া অন্য সবার মতো পড়ে না, একটু অন্যরকম করে পড়ে। তার পড়া হল মুখস্থ করে পড়া। কখগ একটি সমকোণী ত্রিভুজ। এই বাক্যটা সে কুড়িবার পড়বে। তারপর খাতায় লিখবে ঠিকমতো মুখস্থ হয়েছে কিনা দেখার জন্যে। তারপর সে শুরু করবে পরের বাক্যটা।
কখ এবং কগ তাহার দুইটি বাহু।
কখ এবং কগ তাহার দুইটি বাহু।
কখ এবং কগ তাহার দুইটি বাহু।
জ্যামিতির একটা সম্পাদ্য মুখস্থ করতে তার এক রাত লাগে। মুখস্থ করার সময় হুটহাট করে তার ঘরে কেউ ঢুকলে মুখস্থ জিনিস সব এলোমেলো হয়ে যায়। কুসুম আপু এই কাজটাই করে। হুট করে ঘরে ঢুকে সব এলোমেলো করে দেয়।
এ বছর না কি A Village Fair রচনাটা আসবেই। তিনরাত ধরে ভাইয়া রচনা মুখস্থ করছে। দুই রাতেই তার একটা রচনা মুখস্থ হয়। কুসুম আপুর জন্যেই তিন রাতেও কিছু হচ্ছে না। চোখ বন্ধ করে ভাইয়া রচনা মুখস্থ করা শুরু করতেই কুসুম আপু সাড়া শব্দ করে দরজার সামনে দিয়ে হাঁটাহাঁটি করা শুরু করে। পরশু রাতেও করেছে। গতকাল রাতেও করেছে। রঞ্জু ভাইয়া বিরক্ত হয়ে বলল, ডিসটার্ব করিস কেন?
কুসুম আপু অবাক হয়ে বলল, ডিসটার্ব কী করলাম?
এই যে একশবার দরজার সামনে দিয়ে যাচ্ছিস আসছিস ডিসটার্ব হচ্ছে না?
তোমার পড়া তুমি পড়বে। ডিসটার্ব হবার কী আছে? পড়ায় মন থাকলে তোমার মাথায় অন্য কিছুই ঢুকত না। কে হাঁটছে, কে কাশছে বুঝতেই পারতে না। তোমার পড়ায় মন নেই। তুমি গত বছর ফেল করেছ। এ বছরও ফেল করবে।
আমার ফেল আমি করব। তুই কথা বলার কে?
আমি কথা বলার কেউ না। এবার ফেল করলে আমি তোমাকে রূপার একটা মেডেল দেব। মেডেলে লেখা থাকবে–
আখলাক হোসেন
ফেলকুমার
আমি বুঝতে পারছি ভাইয়া অসম্ভব রেগে যাচ্ছে। রাগ সামলাবার চেষ্টা করছে, পারছে না। বাবার কাছে শুনেছি ছোট বেলায় রেগে গেলেই ভাইয়া চিৎকার করে কাঁদত। এখন কাঁদে না। তবে চোখে পানি টলটল করে। ভাইয়ার রাগ চোখের পানি দেখে সবাই বুঝে ফেলে, শুধু কুসুম আপু মনে হয় বুঝতে পারে না। সে ভাইয়ার রাগ আরো বাড়ানোর চেষ্টা করে।