ভাইয়ার ঘরে উঁকি দিয়ে বলেন, পড়াশোনা ঠিকমতো হচ্ছে তো। আগে ভাগে বর্ষা নামায় তোর জন্যে ভালো হয়েছে। গরম কমেছে।
ভাইয়া বাবার কোন কথার জবাব দেয় না। কথার মাঝখানে বই এর পাতা উল্টাতে থাকে। তার ভাবটা এ রকম যেন পড়াশোনার মাঝখানে কথা বলায় সে খুবই বিরক্ত।
বাবা এই ঘর শেষ করে যান মার ঘরে। হারিকেন নামিয়ে মার ঘরের খাটের নিচে অনেকক্ষণ উঁকি ঝুঁকি দেন। সাপ খুঁজেন। প্রতি বর্ষায় মার ঘরে একবার না একবার সাপ বের হয়। এবারের বর্ষায় এখনো বের হয় নি। তবে বের হবে এটা প্রায় নিশ্চিত। সাপ খোঁজার ফাঁকে ফাঁকে মার সঙ্গে তার নিশ্চয়ই কোনো কথাবার্তা হয়। কি কথাবার্তা হয় আমি জানি না কারণ দুজনই কথা বলেন খুব নিচু গলায়।
মার ঘর শেষ করার পর বাবা যান রহিমা ফুপুর ঘরে। এই সময় বাবার মেজাজ বেশ ভালো থাকে। তাঁর হাসির শব্দও মাঝে মাঝে শোনা যায়। কুসুম আপুর সঙ্গেও তিনি উপদেশমূলক কিছু কথাবার্তা বলেন। কারণ কুসুম আপুও এবার এস এস সি পরীক্ষা দিচ্ছে। যারা এস এস সি পরীক্ষা দেয় তাদেরকে সব সময় উপদেশ দেয়াই নিয়ম। কুসুম আপুর সঙ্গে কথা বলার সময় বাবার গলা অতিরিক্ত কোমল হয়ে যায়।
পড়াশোনা কেমন হচ্ছে রে মা?
ভালো।
একটা কথা খেয়াল রাখবি। সারারাত জেগে পড়বি না। ছেলেরা সারারাত জেগে পড়লে কোনো সমস্যা নাই। সেটাই নিয়ম। কিন্তু মেয়েরা সারারাত জেগে পড়লে সমস্যা।
কী সমস্যা?
মুখের জ্যোতি কমে যায়।
ছেলেদের জ্যোতি কমে না। মেয়েদের কমে কেন?
ছেলে মেয়ে সবারই জ্যোতি কমে। ছেলেদের জ্যোতি কমলে কিছু যায় আসে না। মেয়েদের জ্যোতি কমলে যায় আসে। মেয়েদের আসল সম্পদ হল তাদের মুখের জ্যোতি।
আপনি কী সব অদ্ভুত কথা যে বলেন চাচা।
আমার নিজের কথা না। ময়—মুরুব্বীর কথা।
এগুলি মোটেই কোনো ময়—মুরুব্বীর কথা না। আপনার নিজের কথা। আপনি স্টেশনে একা একা জেগে থাকেন আর অদ্ভুত অদ্ভুত সব কথা বানান।
বাবার নিশ্চয়ই স্টেশন ঘরে একা ঘুমুতে ভালো লাগে না। তিনি নানান অজুহাতে দেরি করতে থাকেন। সবার সঙ্গে কথা শেষ হবার পর বারান্দায় এসে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকেন। এই সময় আমিও বারান্দায় চলে আসি। কারণ তখন খুব মজার একটা ঘটনা ঘটে। মজার ঘটনা সবদিন ঘটে না। মাঝে মধ্যে ঘটে। আমাদের বাসার সামনে দক্ষিণ দিকে কিছু নিচু জায়গা আছে। বর্ষার পানিতে জায়গাটা ড়ুবে গেছে। প্রায় হাঁটুপানি। স্টেশনে যাবার পথে বাবা শুকনো জায়গা ছেড়ে হঠাৎ পানিতে নেমে যান। হারিকেন হাতে নিয়ে ছপছপ শব্দে এ মাথা ও মাথা হাঁটেন। রাজ্যের ব্যাঙ তখন বাবাকে ঘিরে লাফালাফি করতে থাকে। কোনো কোনো সাহসী ব্যাঙ লাফ দিয়ে এসে বাবার গায়ে পড়ে। তিনি মনে হয় খুব মজা পান। কারণ আমি বারান্দা থেকে বাবার চাপা গলার হাসি শুনি। বাবার গলার হাসির শব্দ ব্যাঙের ডাকের মতো শোনা যায়। ব্যাঙের রাজত্বে বাবাকে লম্বা একটা ব্যাঙ বলে মনে হয়।
বারান্দায় বাবার সঙ্গে আমারো কিছু কথা হয়। বাবা সংকুচিত গলায় প্রায় অনুরোধের মতো করে বলেন, কিরে আমার সাথে ইস্টিশনঘরে ঘুমুতে যাবি? সিন্দুকের উপর নতুন তুলার তোষক দিয়েছি। শিমুল তুলা। মনে হবে বাতাসের উপর ঘুমুচ্ছিস। আরামের ঘুম হবে। এক ঘুমে রাত কাবার। হিসি করার জন্যেও ঘুম ভাঙবে না।
আমি বলি, না।
না কেন? বাপ-ব্যাটায় গল্প করতে করে ঘুমাব। অসুবিধাটা কী?
অসুবিধা কিছুই নেই। বাবার সঙ্গে ঘুমনো আমার জন্যে আনন্দময় ঘটনা। কিন্তু আমি রাজি হই না মাকড়শার ভয়ে। বর্ষাকাল হল মাকড়শাদের ডিম পাড়ার কাল। আশেপাশের যত মাকড়শা আছে সব পেটে ডিম নিয়ে। ইস্টিশনঘরে চলে এসেছে। একটা মাকড়শা ভাতের থালার মতো বড়। চোখ নীল রঙের। অন্ধকারে জ্বলে। এই মাকড়শাটা সোজাসুজি হাঁটে না, কেমন হেলে দুলে হাঁটে।
আব্দুর রহমান চাচাকে মাকড়শাটা দেখিয়ে দিলাম। তিনি গলা নামিয়ে ফিস ফিস করে গোপন সংবাদ দেবার ভঙ্গিতে বলেছেন, বাবা এইটা মাকড় না। এর নাম ধোকড়। অন্য জাত। এরার শইল্যে সামান্য বিষ আছে।।
আমি অনুরোধের ভঙ্গিতে বলেছিলাম, কী ভয়ংকর দেখতে। মেরে ফেলেন না।
রহমান চাচা উদাস ভঙ্গিতে বলেছেন, আমি নিরুপায়। তুমি কেন রেলের বড় সাহেব হুকুম দিলেও মারতে পারব না। আমরা ইসলাম ধর্মের মানুষ। ইসলাম ধর্মে মাকড় মারা নিষেধ। কঠিন নিষেধ। মুসলমান না হইয়া আমি যদি হিন্দু হইতাম মাকড় মাইরা সাফ কইরা দিতাম। হিন্দু ধর্মে সাপ মারায় দোষ আছে, মাকড় মারায় নাই। একেক ধর্মে একেক ব্যবস্থা।
আমাদের ধর্মে নিষেধ কেন?
একবার একটা মাকড়শা গুহার মুখে জাল বানাইয়া নবিজির জীবন রক্ষা করেছিল। এই জন্য মাকড়শা মারা নিষেধ। গল্পটা শুনতে চাও?
চাই।
তা হইলে বস। কুলি কইরা আসি। গাঁজা খেয়েছি। মুখে দুর্গন্ধ। মুখে দুর্গন্ধ নিয়া নবিজির বিষয়ে কোনো গল্প করলে নেকির বদলে তিনটা বদি লেখা হয়।
রহমান চাচা কুলি করতে গেলেন। আর ফিরে এলেন না। ফিরে আসার কথাও না। কোন কিছুই তাঁর বেশিক্ষণ মনে থাকে না। তাঁর মাথা আগেই আউলা ছিল। একা একা রাতে বিরাতে মগরা ব্রিজের কাছে বাতি নিয়ে বসে। থাকার জন্যে তাঁর মাথা দ্রুত আউলা হচ্ছে। একদিন আমাকে ডেকে গলা নিচু করে বললেন, আবুটার বাড়ি শ্রীহট্ট।
আমি বিস্মিত হয়ে বললাম, কার বাড়ি শ্রীহট্ট?
রহমান চাচা ফিস ফিস করে বললেন, ঐ যে একটা পুলা মগরা ব্রিজের লাইনের উপরে বইস্যা থাকে। তার বাড়ি এই অঞ্চলে না। বাড়ি শ্রীহট্ট।