সে আসবে তোমার সঙ্গে?
অবশ্যই আসবে। মানুষ যেমন আদর বুঝে। ভূত প্রেতও বুঝে। ওকে ঘরে এনে আমি পালবো। একটা ভূত পালার আমার অনেক দিনের শখ।
আমার সাহস খুব কম তারপরেও ঠিক করে রেখেছি। কোনো এক রাতে কুসুম আপুকে নিয়ে মগরা ব্রিজের নিচে দাঁড়িয়ে থাকবো। রাত দুটার দিকে যেতে হবে। চিটাগং মেইল রাত দুটার সময় আসে। এই ট্রেনের সার্চ লাইটের আলো এক মেইল দূর থেকে দেখা যায়। সার্চ লাইটের আলোয় ছেলেটাকে দেখা যাবে।
আমার মাথার উপর ভেজা গামছা। আমি যাচ্ছি ফজলু ভাই-এর খোঁজে। ফজলু ভাই রঞ্জু ভাইয়ার প্রাণের দোস্ত। তিনিও এবার এস. এস. সি. পরীক্ষা দিয়েছেন। রঞ্জু ভাইয়া পাস করতে না পারলেও ফজলু ভাইয়া করেছেন। সেকেন্ড ডিভিশন এবং জেনারেল অংকে লেটার। অংক পরীক্ষার দিন খুব ভালো নকল সাপ্লাই হওয়ায় এই লাভটা তার হয়েছে। যারা ফেল করেছে। তারাও অংকে লেটার পেয়েছে।
নিউ স্টার রেস্টুরেন্টের সামনে দিয়ে যাচ্ছি। রেস্টুরেন্ট খালি। বেঞ্চের উপর ধলা সামছু শুয়ে আছেন। আমাকে দেখেই উঠে বসে ব্যস্ত ভঙ্গিতে ডাকলেন—এই ছেলে এই তুমি রঞ্জুর ভাই না?
আমি মাথা নাড়লাম।
মেট্রিকে তোমার ভাই ফেল করেছে শুনলাম। বড়ই আফসোস। নকলের তো ভালো সুবিধা ছিল, ফেল করল কেন জান?
জি না জানি না।
চৈত্র মাস। ভেজা কাপড় মাথায় দিয়া হাঁটা ঠিক না। মগজে ঠাণ্ডা বসে যায়। ভেজা কপড়টা নামাও। আমার কাছে ছাতি আছে নিয়া যাও। পরে ফিরায়ে। দিও। এই ছেলে এই…
ধলা সামছু ব্যাকুল হয়ে আমাকে ডাকছেন, আমি হাঁটতে শুরু করেছি। গরম বাতাস চোখে মুখে লাগছে। চামড়া চিড়বিড় করছে। মনে হচ্ছে মুখের উপর দিয়ে একদল পিঁপড়া হাঁটছে। সব কটা পিঁপড়ার মুখে ডিম। এরা ডিম নামিয়ে বিশ্রাম করে। গরম বাতাসের ঝাপ্টা এলেই ডিম মুখে নিয়ে দৌড়তে শুরু করে। পিঁপড়ার পা গুলি ঠাণ্ডা কিন্তু ডিমগুলো কুসুম কুসুম গরম।
একেক বছর একেক রকম হয়
একেক বছর একেক রকম হয়।
গত বছর বৃষ্টিই হয় নি। বড় বড় পুকুর শুকিয়ে গেছে। টিউবওয়েলে পানি উঠে না। এ বছর আগেই বর্ষা নেমে গেল। জ্যৈষ্ঠ মাসেও সারাদিন বৃষ্টি, ঠাণ্ডা-ঠাণ্ডা আবহাওয়া। আম কাঁঠাল পাকা বন্ধ। গরমই পড়ে নি আম কাঁঠাল পাকবে কি? অসময়ের বৃষ্টির পানিতে মাগরা নদী ফুলে ফেঁপে উঠল। গভীর রাতে ঘুম ভাঙলে নদীর হাসি শোনা যায়। হিহি হোহো করে নদী হাসে। নদীর হাসি খুব খারাপ। যে বছর নদী হাসে, সেই বছর ভয়ংকর কিছু হবেই। ভৈরব থেকে রেলের ইঞ্জিনিয়াররা একদিন মাগরা ব্রিজ দেখতে এলেন। সুতা ফেলে কি সব মাপজোখ করলেন। তাদের মুখ গম্ভীর হয়ে গেল। তারপর থেকে নিয়ম হল। কোনো ব্রিজ সরাসরি মগরা ব্রিজে উঠবে না। ব্রিজে উঠার আগে থামবে। হুইসাল দেবে। একজন পয়েন্টসম্যান সবুজ পতাকা দেখাবে, কিংবা সবুজ বাতি জ্বালাবে। তখনি ট্রেন ব্রিজে উঠবে। নান্দাইল রোড স্টেশনের পয়েন্টসম্যান আব্দুর রহমান চাচা এই খবর শুনে খুবই রেগে গেলেন। চিৎকার, চেঁচামেচি, খারাপ গালাগালি—রেলের সাহেবের মারে আমি….।
বাবা শান্তগলায় বললেন, খারাপ গালাগালি দেবে না। রেল সাহেবের মা নিশ্চয়ই বেঁচে নেই। আর বেঁচে থাকলেও তিনি একজন সম্মানী বৃদ্ধা মহিলা। তাছাড়া তিনি কোনো দোষও করেন নি। তাকে নিয়ে নোংরা কথা বলা ঠিক না। রেলের ডিসিসান তোমার যদি পছন্দ না হয়, চাকরি ছেড়ে দাও।
রহমান চাচা লাফ ঝাঁপ দিতে দিতে বললেন, চাকরি তো ছাড়বই। চাকরির মারে আমি….. এই বৃষ্টি বাদলার দিনে আমি দোষ লাগা পুলের উপর একলা বইস্যা থাকব। আর জিন ভূতে আমারে গলা টিপ্যা মারব। আমার অত গরজ নাই। রেলের চাকরির মারে….।
অনেক লাফ ঝাঁপ দিলেও সন্ধ্যার আগে আগে রহমান চাচা গামবুট পরে রেলের লণ্ঠন নিয়ে রওনা হলেন। গামবুট জোড়া বাবার। গত বর্ষায় কিনেছিলেন। বাবার ধারণা কেনার পরপরই এক সাইজ ছোট হয়ে গেছে। পরার পর আঙুল বেঁকে থাকে। গামবুট জোড়া তিনি রহমান চাচাকে দিয়ে দিয়েছেন। রহমান চাচার পায়ের পাতা বাবার পায়ের পাতার চেয়েও লম্বা। গামবুট পরার পর তার পায়ের সব কটা আঙুল নিশ্চয়ই বেঁকে থাকে। তবে তাতে তার অসুবিধা হয় না।
মগরা ব্রিজের সামনে এই প্রথম ফ্লাগ ম্যান বসানো হচ্ছে। কাজেই বাবা রহমান চাচার সঙ্গে গেলেন। রহমান চাচাকে জায়গা মতো বসিয়ে তিনি চলে আসবেন। বাবা তাকে অনেক সান্ত্বনার কথাও বললেন—একা একা বসে গাঁজা খাবি। অসুবিধা কী? ট্রেন পার করিয়ে দিয়ে ইস্টিশনে এসে লম্বা ঘুম দিবি। হাঁটাচলা করায় তোর স্বাস্থ্যটাও ভালো থাকবে। গাঁজা খেয়ে শরীরটার তো বারোটা বাজিয়েছিস।
বর্ষা শুরু হবার পর থেকে বাবাকে স্টেশনঘরে ঘুমুতে হচ্ছে। ঘরে থাকার জায়গা নেই। মা বেশ কিছুদিন হল বাবাকে ঘরে থাকতে দিচ্ছেন না। বাবার সঙ্গে কথাও বলছেন না। গরমের সময় হলে বাবা বারান্দায় শুয়ে থাকতে পারতেন। ঘোর বর্ষায় সেটা সম্ভব না। ভাইয়া আবার পরীক্ষা দিচ্ছে বলে সারারাত জেগে পড়ে। ঘুম কাটাবার জন্যে মাঝে মাঝে তাকে বিড়ি খেতে হয়। সিগারেটে ঘুম কাটে না। বিড়িতে লম্বা টান দিলে ঘুম কাটে। কাজেই তার ঘরে সে বাবাকে ঢুকতে দেবে না। রাতে ভাত খাবার পর বাবা পান মুখে দিয়ে ইস্টিশনঘরের দিকে রওনা হন। যেন অনেক দূর দেশে দীর্ঘদিনের জন্যে চলে যাচ্ছেন। কবে ফিরবেন তাও অনিশ্চিত, এমন ভঙ্গিতে সবার সঙ্গে কথাবার্তা বলেন।