বাবার ধারণা পৃথিবীতে দুধরণের মানুষ আছে—নদী মানুষ আর পুকুর মানুষ। নদীর পানি যেমন বয়ে চলে যায়। নদী মানুষের রাগও বয়ে চলে যায়। যে নদী মানুষের স্রোত বেশি তার রাগ তত তাড়াতাড়ি কমে। পুকুর মানুষের। রাগ কমে না। ভাইয়া হল খরস্রোতা নদী। এই রাগ উঠে গেছে, এই নাই। আর। বাবা হল দিঘি। কিছুতেই রাগ উঠবে না। ভাইয়ার জায়গায় যদি বাবা হত— আর যদি বাবা বলতেন—যা দৌড় দিয়ে একটা তেনা নিয়ে আয়। তার উত্তরে আমি যদি বলতাম, পারব না। তাহলে বাবা বলতেন, না পারলে নাই। সবাই সবকিছু পারে না। তুই হাসি মুখে আমার সামনে বসে থাক এতেই আমি খুশি। মানুষের হাসি মুখের দাম—তিন লাখ টাকা। আর মানুষের বেজার মুখের দাম তিন পয়সা।।
তেনা নিয়ে এসে দেখি ভাইয়া পাকা মিস্ত্রির মতো সাইকেলের দুটা চাকাই খুলে ফেলেছে। তাকে খুবই আনন্দিত মনে হচ্ছে। দেখে মনেই হয় না আজ সকালেই তার ফেল হবার খবর এসেছে।
ভাইয়া তেনা হাতে নিতে নিতে বলল, বাসার অবস্থা কী?
অবস্থা ভালো।
আমার ফেল করার কথা শুনে মা কী বলল?
কিছু বলে নাই।
কিছুই বলে নাই?
না। মার আধকপালী উঠেছে এই জন্যে দরজা বন্ধ করে শুয়ে আছে।
কুসুম কী বলেছে?
কিছু বলে নাই।
কিছুই না? উঁহুঁ।
ফেলের খবর শুনে তার মুখটা কি বেজার বেজার হয়ে গেল না হাসি খুশি হয়ে গেল?
বেজার বেজার হয়েছে।
ঠিক তো?
হুঁ ঠিক।
কুসুমকে দেখে কি মনে হয়েছে খবরটা সে ঠিক বিশ্বাস করতে পারছে না।
হুঁ।
হুঁ আবার কী? ঠিক করে বল। কথা বলতে ট্যাক্স লাগে যে হুঁ হাঁ। করছিস। কুসুমের মুখ দেখে কী মনে হয়েছে পরিষ্কার করে বল।
মনে হয় বড়ই দুঃখ পেয়েছে।
মুখ দেখে কী করে বুঝলি দুঃখ পেয়েছে। কেউ দুঃখ পেলে কি কপালে লেখা উঠে—দুঃখ! লেখা উঠে না। মানুষের মুখ দেখে কিছুই বোঝার উপায় নাই। মানুষ খুবই জটিল জিনিস। এরচে যন্ত্র ভালো। যন্ত্র দেখলে বোঝা যায় যন্ত্র ঠিক আছে না, নষ্ট। এখন বল দেখি একটা মানুষ আর একটা সাইকেল এই দুই এর মধ্যে কোনটা ভালো?
সাইকেল।
গুড। হয়েছে। এখন যা ফজলুকে ডেকে নিয়ে আয়। রোদটা অবিশ্যি চড়া উঠেছে। এক কাজ কর সার্টটা খুলে কলের পানিতে ভিজিয়ে মাথার উপর দিয়ে চলে যা। রোদ টের পাবি না, ঠাণ্ডায় ঠাণ্ডায় চলে যাবি। পারবি না?
পারব। উনাকে কী বলব?
আসতে বলবি। আজ মনের সাধ মিটিয়ে ঝপাং খেলা খেলব। এক কাজ কর ফজলুর কাছে যাবার আগে কুসুমকে বলে যা সে ঝপাং খেলা দেখতে। চেয়েছিল আজ ইচ্ছা করলে দেখতে পারবে।
আচ্ছা।
ঝপাং খেলাটা খুবই ভয়ংকর। ভয়ংকর বলেই খুব মজার। এই খেলার নিয়ম হল মাগরা নদীর উপর রেলের ব্রীজে চলে যেতে হয়। ব্রিজের উপর রেল লাইনে চুপচাপ বসে থাকতে হয়। সাড়ে চারটার সময় ঢাকা মেইল আসে। ড্রাইভার রেল লাইনের উপর মানুষ বসে থাকতে দেখে দূর থেকে হুইসাল বাজাতে থাকে। ইঞ্জিন কাছাকাছি চলে এলে ঝপাং করে ঝাঁপ দিয়ে মাগরা নদীতে পড়ে যেতে হয়। ইঞ্জিন কতটা দূর থাকতে ঝাঁপ দেয়া হয়েছে এর উপর নির্ভর করে খেলার হারজিৎ। এখন পর্যন্ত ফজলু ভাইকে কেউ হারাতে পারে নি। ফজলু ভাই লাফ দেয় ইঞ্জিন ব্রিজে উঠার পর। অন্য সবাই ইঞ্জিন অনেক দূরে থাকতেই ভয় পেয়ে লাফ দিয়ে পানিতে পড়ে যায়।
আমার খুব ইচ্ছা একদিন ঝপাং খেলাটা খেলি। ক্লাস টেনে উঠার আগে এই খেলা খেলা যায় না। তাছাড়া প্রথমবার এই খেলা খেলতে যাওয়াও খুবই বিপজ্জনক। বাঁকের ভেতর হঠাৎ ট্রেন বের হয়ে আসে। সেটা দেখে হাত পা না কি জমে যায়। ঝাঁপ দেয়ার কথা মনে থাকে না। তখন ধাক্কা দিয়ে পানিতে। ফেলে দিতে হয়। তবে একবার এই খেলা খেলে ফেললে ভয় কেটে যায়। তখন বার বারই এই খেলা খেলার ইচ্ছা করে।
ঝপাং খেলা খেলতে হয় দিনে। রাতে এই খেলা কখনো খেলা হয় না— কারণ রাতের বেলা নাকি এগারো বারো বছরের একটা ছেলেকে রেল লাইনে বসে থাকতে দেখা যায়। অনেকেই দেখেছে। ছেলেটা ধবধবে ফর্সা। মাথার চুল কোঁকড়ানো। সে থাকে খালি গায়। পরনে শুধু একটা প্যান্ট। ট্রেন আসার ঠিক আগে আগে হেড লাইটের আলোয় ছেলেটাকে দেখা যায়। সে আপন মনে পাথর নিয়ে খেলে। ট্রেন যে ঝড়ের মতো ছুটে আসছে এদিকে সে ফিরেও তাকায় না। ট্রেনটা যখন ঠিক তার গায়ের উপর এসে পড়ে তখনই সে শুধু উঠে দাঁড়ায়। ট্রেন তার গায়ের উপর দিয়ে চলে যায়। তারপর আর তাকে দেখা যায় না।
ছেলেটার গল্প সবাই জানে। অনেকেই বিশ্বাস করে অনেকে করে না। যেমন আমার বাবা বিশ্বাস করেন। কারণ যে কোনো উদ্ভট গল্প তিনি বিশ্বাস করেন। তাঁর কাছে অসম্ভব বলে কোনো ব্যাপার নেই। এই ছেলেটার ব্যাপারে বাবার বক্তব্য হল–এটা সত্যি হতে পারে। খেলতে খেলতে পুলের উপর চলে গিয়েছিল। সেখানে ট্রেনে কাটা পড়েছে। তারপর থেকে আত্মাটা ঐখানে রয়ে গেছে। তার যে মৃত্যু হয়েছে এইটাই বেচারা জানে না। রোজ হাশর পর্যন্ত বেচারা এইখানে থাকবে। রোজহাশরের দিন আল্লাহপাক তাকে বলবেন—এই ছেলে যা বেহেশতে গিয়ে ঢুকে পড়। সঙ্গে বাবা মাকে নিতে চাইলে নিয়ে নে। ট্রেন লাইনে অনেক হাঁটাহাঁটি করেছিস আর না। এখন বেহেশতে হাঁটাহাঁটি কর। বেহেশতের ফল ফ্রুট খা। গেলমানদের সঙ্গে মজা করে মারবেল খেল।
কুসুম আপু এইসব গল্প একেবারেই বিশ্বাস করে না। সে প্রায়ই বলে, একবার আমাকে নিয়ে যাস তো। সারারাত পুলের নিচে বসে থেকে ছেলেটাকে দেখব। এ-রকম সত্যি যদি কেউ থাকে হাত ধরে তাকে বাড়িতে নিয়ে আসব।