আমার প্যান্টের পকেটে পঞ্চাশ টাকার একটা নোট। পকেটে হাত ঢুকিয়ে আমি নোটটা ধরে আছি এবং খুঁজে বেড়াচ্ছি ভাইয়াকে। তাকে খুঁজে পাওয়া। তেমন কঠিন না। বেশির ভাগ সময় ভাইয়া ইস্টিশনের চায়ের স্টলে বসে। থাকে। তবে কখনো চা খায় না। চা নাকি তার কাছে মিষ্টি গরম পানির মতো লাগে। পয়সা খরচ করে গরম পানি খাওয়ার দরকার কী? পানি যত ঠাণ্ডা তত। মজা।
কিছুদিন আগেও ইস্টিশনে দুটা চায়ের স্টল ছিল মুসলিম টি স্টল এবং হিন্দু টি স্টল। এখন হিন্দু টি স্টলটা উঠে গেছে। মুসলিম টি স্টলও উঠি উঠি। করছে, কাস্টমার নাই। ইস্টিশনের বাইরে নতুন এক চায়ের দোকান হয়েছে–নিউ স্টার রেস্টুরেন্ট। এরা সন্ধ্যার পর হ্যাজাক বাতি জ্বালায়। হিন্দি গান বাজায়। নিউ স্টার রেস্টুরেন্টের মালিক কেন্দুয়া থেকে জিলাপির এক কারিগর এনেছে। বিকালে সেই কারিগর জিলাপি বানায়। এর মধ্যেই জিলাপির নাম ডাক ছড়িয়ে পড়েছে–ধলা সামছুর জিলাপি। সামছু জিলাপি কারিগরের নাম। তার গায়ের রঙ ধবধবে সাদা বলেই সবাই ডাকে ধলা সামছু।
ধলা সামছু সন্ধ্যার পর গোসল করে একটা পাঞ্জাবি পরে রেস্টুরেন্টের বাইরে বেঞ্চির ওপর বসে থাকেন। তাকে তখন কলেজের প্রফেসরের মতো লাগে। ধলা সামছুর কথা বলা রোগ আছে। উনি কথা না বলে থাকতে পারেন না। আমি একদিন সন্ধ্যার পর দুটাকার জিলাপি কিনতে গেলাম। উনি বললেন, তুমি কে গো? নাম কী? নামটা সুন্দর করে বল বাপধন। সুন্দর করে নাম বলতে পারা একটা মোহাব্বত।
টগর।
উত্তম নাম। জিলাপি কিনবা?
হুঁ।
দুই টেকার জিলাপি?
হুঁ।
দুই টেকায় চাইরটা পাইবা। পঞ্চাশ পয়সা কইরা পিস। বাড়িতে মানুষ কয়জন? চাইর পিসে হইব? নিজের দোকান হইলে তোমারে পাঁচ পিস দিতাম। কিন্তু অন্যের দোকান–আমি হইলাম হুকুমের চাকর। আমি নিজে যদি জিলাপি খাইতে চাই আমারে পয়সা দিয়া কিনন লাগব। বুঝলা বিষয়টা?
বুঝেছি।
জিলাপি খাইতে হয় গরম গরম। ঠাণ্ডা জিলাপির কোনো মজা নাই। দুইটা জিনিস খাইতে হয় গরম এক জিলাপি, দুই চা। ঠাণ্ডা জিলাপি আর ঠাণ্ডা চা। দুইই বিষ–এইটা মনে রাখবা। গরম জিলাপি এক কেজি খাইতে পার, কিচ্ছু হবে না। ঠাণ্ডা জিলাপি দশটা খাইবা সাথে সাথে পাতলা পায়খানা। টাট্টিঘরে যাইতে হবে দিনে পাঁচবার।
আমার বাবার ধারণা—সুখি মানুষরা বেশি কথা বলে। বাবা মাঝে মধ্যে। জ্ঞানী- জ্ঞানী কথা বলেন। জ্ঞানী কথা বলার সময় তিনি আমাকে ডাক নামে ডাকেন না—ভালো নামে ডাকেন। টগর না ডেকে ডাকেন মোতাহার। আমার ভালো নাম মোতাহার উদ্দিন।
বুঝলি মোতাহার। একটা মানুষ সুখী না দুঃখী চট করে বলে ফেলা যায়। ভালোমতো তাকে দেখবি। যদি দেখিস বেশি কথা বলছে তাহলেই বুঝবি সে সুখী মানুষ। আর যদি দেখিস কথাবার্তা কম বলছে তাহলেই বুঝবি—মনের মধ্যে অনেক দুঃখ। সবচে বেশি কথা বলে কারা? পাগলরা। সারাক্ষণই এরা কথা বলে। আশেপাশে মানুষ থাকলে কথা বলে। আশেপাশে কেউ না থাকলে নিজের মনেই বিড়বিড় করে। এই দুনিয়ার সবচে সুখী মানুষ কারা? পাগলরা। একবার কষ্ট করে পাগল হয়ে যেতে পারলে খুবই মজা। আর কোনো দুঃখ নাই। শুধুই সুখ। এইসব ভেবেই পাগল হয়ে যেতে ইচ্ছা করে।
বাবার জ্ঞানের কথা বেশির ভাগই আমার কাছে মনে হয় ভুল। কারণ ধলা সামছু একজন দুঃখী মানুষ। তার বৌ তাকে ছেড়ে চলে গেছে। কিন্তু বেশি দূর যায় নাই। রোয়াইলবাজারে খারাপ ঘরে জায়গা নিয়েছে। তার ভিজিট দশ টাকা। এইসব বড়দের ব্যাপার। তবে ছোটরাও সবাই জানে। বৌটার নাম সোহাগী। আমি তাকে দেখি নি—শুনেছি ছোটখাট। হাস্যমুখী। অনেক ঢং-ঢং নাকি জানে। গীতও নাকি গায়। তার কাছে যে যায় সেই খুশি হয়ে আসে। যে একবার গেছে সে পরে আরো পাঁচবার যায়। আমার খুব ইচ্ছা দূর থেকে। একদিন তাকে দেখে আসব। দূর থেকে দেখলে তো আর ভিজিট লাগবে না।
ভাইয়া চায়ের দোকানে ছিল না। সে ইস্টিশনের শিমুল গাছের গুঁড়িতে বসে সাইকেলের চেইন ঠিক করছিল। ভাইয়ার চেহারা কিছুদিন আগেও খুব সুন্দর ছিল। এখন দাড়ি গোঁফ গজিয়ে বিশ্রী হয়ে গেছে। কেমন গুন্ডা-গুন্ডা ভাব এসে গেছে। গরম লাগে বলে চুল ছোট ছোট করে কাটে। চুল কাটলে সব পুরুষ মানুষকে প্রথম দুদিন বান্দরের মতো লাগে তারপর ঠিক হয়ে যায়। শুধু ভাইয়ার বেলায় দেখলাম চুল কাটার দশ পনেরো দিন পরেও তার চেহারা থেকে বান্দর ভাব দূর হয় না বরং বেড়ে যায়। কিছুদিন আগেও তার দাঁতগুলি মুখের ভেতর ছিল—এখন মনে হয় মুখ ঠেলে বের হয়ে আসতে চাচ্ছে। ভাইয়ার চুল যখন লম্বা থাকে তখন দাঁতগুলি থাকে মুখের ভেতর। চুল ছোট হলেই দাঁত মুখ থেকে বের হয়ে আসে। এটা একটা বিরাট রহস্য।
ভাইয়া সাইকেল থেকে চোখ না তুলে বলল, দৌড় দিয়ে একটা তেনা নিয়ে আয়। ঝড়ের মতো যাবি। সাইক্লোনের মতো ফিরে আসবি।
আমি দৌড় দিলাম না। পকেট থেকে টাকাটা বের করতে করতে বললাম, বাবা এই টাকাটা তোমাকে দিয়েছে।
ভাইয়া টাকার দিকে না তাকিয়ে বলল, তোকে যে বললাম এক দৌড় দিয়ে তেনা নিয়ে আসতে এটা কানে যায় নাই। সাইকেলটা তুলে মাথায় একটা আছাড় দিব?
টাকাটা নাও, আমি তেনা নিয়ে আসি।
টাকা রেল লাইনে ফেলে দে। ঘুষখোর বাপের টাকার ধার রঞ্জু ধারে না।
আমি টাকাটা পকেটে নিয়ে তেনা আনতে রওনা হলাম। আমি নিশ্চিত তেনা নিয়ে এসে দেখব ভাইয়ার রাগ পড়ে গেছে। ভাইয়ার রাগ আষাঢ় মাসের রোদের মতো। এই আছে এই নাই।