মা সঙ্গে সঙ্গে বললেন, রঞ্জু। পাক্কার মধ্যে শুইয়া আছে কেন? তার কী। হয়েছে?
বাবা বললেন, পাক্কা না। বরফে শুয়ে আছে। রঞ্জু বিদেশে আছে। খুব ভালো আছে। তোমার জন্যে টাকা পাঠিয়েছে।
মা ভাইয়াকে চিনতে পারলেও আমাকে বা বাবাকে একেবারেই চিনতে পারলেন না। আমাকে রাগী গলায় বললেন—এই ছেলে তুমি একটু দূরে সরে বস। গায়ের উপর উঠে যাচ্ছ কেন? বাপ-মা সহবত শিক্ষা দেয় নাই?
জাপানি ইঞ্জিনিয়ার সাহেবের কথা বলা হয় নি। তার কথা বলি। চীনাম্যান হত্যা মামলায় তাকেও আসামি করা হয়। জমশেদ জবানবন্দিতে বলে, সে যা করেছে সাইট ইঞ্জিনিয়ার কামরুল ইসলাম সাহেবের নির্দেশে করেছে। মামলা অনেক দিন চলে। রায় হয়। জাপানি ইঞ্জিনিয়ারের যাবজ্জীবন কারাদন্ড এবং তিনজনের ফাঁসির হুকুম হয়। জাপানি ইঞ্জিনিয়ার হাজত থেকে কুসুম আপুকে একটা চিঠি লেখেন। কুসুম আপু থাকেন রাজশাহীতে সেই চিঠিটা আমি নিজের কাছে রেখে দেই। চিঠিতে তিনি লিখেছেন–
প্রিয় কুসুম
Miss Flower,
আমাদের মামলার রায় হয়েছে। সেই খবর নিশ্চয়ই পত্রিকা মারফত জেনেছ।। সবার ধারণা বিদেশী নাগরিক হত্যার কারণে রায় অত্যন্ত কঠোর হয়েছে। আমার দুর্ভাগ্য আমি যে নির্দোষ এটা প্রমাণ করতে পারি নাই। অবশ্য যাবজ্জীবন কারাদন্ড শুনতে যেমন ভয়াবহ আসলে তা না। ভালো ব্যবহারের কারণে জেলখানায় অনেক রেয়াত পাওয়া যায়। যাবজ্জীবন কারাদন্ড প্রাপ্ত আসামিদের কেউই দশ থেকে এগার বছরের বেশি জেল খাটে না। আমি অনেক চিন্তা ভাবনা করে দেখেছি দশ বছর পর তোমার বয়স হবে মাত্র ২৭, এইটা কোনো বয়সই না। দশ বছর জেলে আমার খুব কষ্টে কাটবে। এটা ঠিক। কষ্টের পরেই সুখ। যার যত কষ্ট। তার তত সুখ। সেই সুখের কথা ভেবেই আমার ভালো লাগছে।
এখন একটা আনন্দের সংবাদ দেই। মামলার রায়ের বিরুদ্ধে আমার ব্যারিস্টার (মশিহুজামান, লিংকনস পাশ করা ব্যারিস্টার। ঝানু লোক। মামলার শুরুতে তাঁকে পেলে খুবই উপকার হত। যাই হোক, আল্লাহর অসীম রহমত তাঁকে এখন পাওয়া গেছে।) হাইকোর্টে আপিল করেছেন। তিনি একশ ভাগ নিশ্চিত হাইকোর্টের রায়ে আমি খালাস পেয়ে যাব। আমার নিজেরো তাই ধারণা।
কুসুম তুমি ভালো থেকো। হতাশ হবে না। আল্লাহ্ পাক যা করেন মানুষের মঙ্গলের জন্যে করেন।
আমি সারাক্ষণই তোমার কথা ভাবি। ঐ ভয়ংকর দিন তাঁবুতে তুমি হঠাৎ কাঁদতে শুরু করলে। ছবিটা এখনো আমার চোখে ভাসে। দুঃখের মধ্যেও আনন্দ পাই।
হাইকোর্টের আপিলের রায় জাপানি ইঞ্জিনিয়ারের জন্যে খুব খারাপ হয়। তিনজনের ফাঁসির জায়গায় হাইকোর্ট জাপানি ইঞ্জিনিয়ার সহ চারজনের ফাঁসির আদেশ দেয়।
কুসুম আপুকে লেখা জাপানি ইঞ্জিনিয়ারের চিঠিটা আমি মগরা ব্রিজ থেকে নদীতে ফেলে দেই। এই চিঠিটার কথা কুসুম আপুর না জানাই ভালো।
কুসুম আপু রাজশাহী থেকে মজার মজার চিঠি লেখেন।
এই টগর। রাতে ট্রেনের শব্দ শুনলেই কিন্তু লাফ দিয়ে বিছানায় উঠে বসবি। কারণ তোদের সবাইকে চমকে দেবার জন্যে কোনো এক রাতে আমি হুট করে উপস্থিত হব। আমি এসে যদি দেখি তুই ঘুমাচ্ছিস, তাহলে কিন্তু অসুবিধা আছে। স্যাম্পল হিসেবে একটা চুল ছিড়ে পাঠালাম। খবর্দার হারাবি না। আমি এলে আমাকে ফেরত দিতে হবে।
রাতে ট্রেনের শব্দ শুনলেই আমার ঘুম ভেঙ্গে যায়। আমি অপেক্ষা করি। অপেক্ষা করতে করতেই মনে হয় সব মানুষের মধ্যে একটা ইস্টিশন থাকে। সেই ইস্টিশনের সিগন্যাল ডাউন করা। ইস্টিশনে সবুজবাতি জ্বলছে।
আনন্দময় ট্রেনের জন্যে অপেক্ষা। কারো কারো স্টেশনে ট্রেন সত্যি সত্যি এসে থাকে। কারো কারো স্টেশনে ট্রেন আসে ঠিকই, কিন্তু মেল ট্রেন বলে থামে না। ঝড়ের মতো উড়ে চলে যায়।
রাতের বেলা ট্রেনের শব্দ শুনলে আমি বিছানায় উঠে বসি ঠিকই কিন্তু স্টেশনে যাই না। ধলা সামছু যায়। হাতে হারিকেন ঝুলিয়ে ছুটে যায়। প্রতিটি কামরা লণ্ঠন উঁচিয়ে দেখে। তার স্ত্রী বাজার ছেড়ে চলে গেছে। ধলা সামছুর ধারণা, কোনো এক রাতের ট্রেনে সে আবারো এখানে ফিরে আসবে। তার স্ত্রী যেহেতু খারাপ মেয়ে মানুষ, সে দিনের ট্রেনে আসবে না। রাতের ট্রেনে আসবে। লম্বা ঘোমটা দিয়ে ট্রেন থেকে নামবে। লম্বা ঘোমটা টানা কাউকে নামতে দেখলেই ধলা সামছু তার কাছে ছুটে যায়। গলা নামিয়ে ফিসফিস করে বলে, আপনার নাম? আপনার পরিচয়?