জাপানি ইঞ্জিনিয়ার বিড়বিড় করে বললেন, টেনশনে জ্বর এসেছে। সকালে নাস্তা টাস্তা কিছুই খাই নি। তারপরেও এক গাদা বমি করেছি। উঠে দাঁড়াতে পারি না। মাথা ঘুরে। সবাই নদীর পারে গিয়েছে। আমি যেতে পারি না। এর অন্য কোনো অর্থ করে কিনা কে জানে।
কুসুম আপু বলল, অন্য কী অর্থ করবে?
বলতে পারে সবাই এসেছে, সে কেন আসে নি? নিশ্চয়ই কোনো কিন্তু আছে।
কিন্তু থাকবে কেন? আপনি নিশ্চয়ই তাকে ধাক্কা দিয়ে ট্রেনের নিচে ফেলে দেন নি?
আমি কেন ধাক্কা দিয়ে ফেলব?
কিংবা আপনি নিশ্চয়ই লোকজনদের শিখিয়ে দেন নি–এই চীনাম্যান। আমাকে খুবই যন্ত্রণা করে তোমরা একে ধাক্কা দিয়ে চলন্ত ট্রেনের সামনে ফেলে দিও।
কুসুম তুমি এইসব কী বলছ?
কথার কথা বলছি।
এ ধরনের কথা ভুলেও উচ্চারণ করবে না। কেউ না কেউ বিশ্বাস করে ফেলতে পারে।
কুসুম আপু কঠিন গলায় বলল, আপনার হাত কাঁপছে কেন ঘটনা কি দয়া করে বলবেন?
কোন ঘটনা না কুসুম। আমার পক্ষে কোনো অন্যায় করা সম্ভব না। সব মানুষ অন্যায় করতে পারে না।
আপনার হাত কাঁপছে কেন?
জানি না কেন কাঁপছে। খুবই ভয় লাগছে।
পুলিশ কি আপনার জবানবন্দি নিয়েছে?
হুঁ।
তাদেরকে কি বলেছেন?
বলেছি আমি কিছুই জানি না। ঘুম থেকে উঠে খবর পেয়েছি। যা সত্য তাই বলেছি।
পুলিশ আপনার কথা বিশ্বাস করেছে।
বিশ্বাস করবে না কেন?
কারণ আমার বিশ্বাস হচ্ছে না। আমার মনে হয় আপনি সব কথা বলছেন।
কুসুম আমার জ্বর এসেছে। সকাল থেকে মাথা ঘুরাচ্ছে। কোনো নাশতা খাই নি। কিন্তু একগাদা বমি করেছি। এখন আবার বমি আসছে। খুবই পানির পিপাসা হচ্ছে। পানি খেতে পারি না। একটু পানি মুখে দেই, মনে হয় পানি না, চিরতার পানি মুখে দেয়েছি।
কুসুম আপু কিছু বলল না, চুপ করে রইল। নদীর পাড় খুব হই চই শোনা যেতে লাগল। মনে হয় ডেড বডির অংশ পাওয়া গেছে। হই চই শুনে জাপানি ইঞ্জিনিয়ারের মুখ হঠাৎ ছাই বর্ণ হয়ে গেল। তিনি বিড়বিড় করে বললেন–রাত তিনটার সময় জমশেদ এসে আমাকে ঘুম থেকে ডেকে তুলল। মদ খেয়ে ভূত হয়ে এসেছে। তার মুখ দিয়ে মদের গন্ধ আসছে। ঠিকমতো দাঁড়াতেও পারছে না, টলছে। আমাকে বলল, চীনাম্যানকে সে মগরা ব্রিজের লাইনের উপর দড়ি দিয়ে বেঁধে রেখেছে। একটু পরেই এগারো সিন্দুর এক্সপ্রেস আসবে। তখন ঘটনা ঘটবে। আমি তার কথা বিশ্বাস করি নি। ভেবেছি মাতালের প্রলাপ। তারপরেও টর্চ লাইট নিয়ে বের হয়েছি। ততক্ষণে এগারো সিন্দুর এসে গেছে। দূর থেকে সার্চ লাইট দেখা যাচ্ছে। আমি ব্রিজে টর্চ মেরে দেখি সত্যি-সত্যি চীনাম্যানকে পুলের উপর শুইয়ে বেঁধে রেখেছে। সে চিৎকার করে তার ভাষায়। কি সব বলছে। কাঁদছে। সে যত কাঁদে জমশেদ আর তার লোকজন তত হাসে। ওদের মাথার ঠিক নাই। গলা পর্যন্ত মদ খেয়েছে। তুমি তো জান কুসুম আমার কোনো সাহস নাই যে আমি ব্রিজের উপর উঠে তাকে বাঁচানোর চেষ্টা করব। এগারো সিন্দুর এক্সপ্রেস আমার চোখের সামনে তার উপর দিয়ে চলে। গেছে। শেষের দিকে চীনাম্যান কোনো চিকারও করে নাই। কান্নাকাটিও করে। নাই। রেল ইঞ্জিনের দিকেও তাকায়ে থাকে নাই। আমার দিকে তাকায়ে ছিল।
জাপানি ইঞ্জিনিয়ার বমি করলেন। নদীর পার থেকে আবার হল্লার শব্দ শোনা গেল। কুসুম আপু বলল, তুই একটু বাইরে গিয়ে বসতো টগর। আমি না। ডাকলে তাঁবুতে ঢুকবি না।
আমি বাইরে দাঁড়িয়ে আছি। দূর থেকে দেখছি—একটা কাটা হাত নিয়ে কে একজন তাঁবুর দিকে আসছে আর পেছনে অসংখ্য মানুষ। কাটা হাতটা থেকে টপ টপ করে পানি পড়ছে।
এক বর্ষা পার হয়ে আরেক বর্ষা এসেছে। সেই বর্ষা চলে গিয়ে আরো এক বর্ষা আমাদের নান্দাইল রোড স্টেশনে এসেছে। সব আগের মতোই আছে। আবার কিছুই আগের মতো নেই।
মগরা ব্রিজের কাছে আবারো তাঁবু পড়েছে। অন্য এক ইঞ্জিনিয়ার সেই তাঁবুতে থাকেন। ভদ্রলোক বয়স্ক। মুখ ভর্তি ধবধবে শাদা দাড়ি। তাঁরও অভ্যাস জাপানি ইঞ্জিনিয়ারের মতো ব্রিজের স্প্যানে সন্ধাবেলা বসে থাকা। তাঁর সঙ্গে জায়নামাজ থাকে। সন্ধ্যা মিলালে তিনি জায়নামাজ পেতে নামাজ পড়েন। দৃশ্যটা দেখতে আমার কেন জানি ভালো লাগে। আমি সুযোগ পেলেই দৃশ্যটা দেখতে যাই।
কুসুম আপুকে তার বাবা নিজের কাছে নিয়ে গেছেন। তিনি তার বাবার সঙ্গে রাজশাহীতে থাকেন। সেখানের কলেজে পড়েন। ছুটি ছাটায় আমাদের দেখতে আসবেন বলে চিঠি লেখেন, কিন্তু আসেন না।।
বাবার পেটের ব্যথাটা সেরে গেছে। কোনো রকম অষুধপত্র ছাড়াই সেরেছে। তবে অসুখ সারলেও হঠাৎ করে বুড়ো হয়ে গেছেন। মাথার চুল সব পেকে গেছে। সামনের পাটির দুটা দাঁতও পড়ে গেছে। যখন কথা বলেন দাঁতের ফাঁক দিয়ে জিহ্বা দেখা যায়। খুবই অদ্ভুত লাগে। তিনি রাতে ইস্টিশনেই ঘুমান। আরেকটা মেল ট্রেনের স্টপেজ এখানে দিয়েছে। কারণ একজন মন্ত্রীর বাড়ি এই অঞ্চলে। মন্ত্রী চেষ্টা তদবির করে নান্দাইল রোড স্টেশনে মেল ট্রেন থামাবার ব্যবস্থা করেছেন। কাজেই এখন নান্দাইল রোড স্টেশনে রাতে তিনটা মেল ট্রেন থামে। বাবাকে স্টেশনে না ঘুমিয়ে উপায় কী।।
বাসায় আমি এবং রহিমা ফুপু আমরা দুজন শুধু ঘুমাই। রহিমা ফুপুর অঘুমা রোগ হয়েছে। সারারাত তিনি হাঁটাহাঁটি করেন। ভাইয়া চলে গেছে বিদেশে। এখন আছে নিউজিল্যান্ডে। তিনি চেষ্টা করে ভাইয়াকে বিদেশে নিয়েছেন। ভাইয়া বরফে হাত পা ছড়িয়ে শুয়ে আছেন এমন একটা ছবি পাঠিয়েছেন। বাবা সেই ছবি দেখে বলেছেন—গাধাটাকে তো চেনা যায় না। করছে কী সে? বরফ খাচ্ছে নাকি? আমি আর বাবা আমরা দুজন মাকে দেখতে গিয়েছিলাম। বাবা, মাকে এই ছবিটা দিয়ে বললেন, সুরমা বলতো কে?