বদরুল স্যার সম্পর্কে এইসব ভালোভালো কথা যিনি বলেন তিনিই আবার গলা নিচু করে অন্যদের বলেন ঘটনা শুনেছেন? বুধবার রাতে রাতে কি ঘটনা। ঘটে শুনেছেন? ছিঃ ছিঃ কী কেলেংকারী।
অনেকদিন পর রেল লাইনে মানুষ কাটা পড়ল। অপঘাতের ঘটনা সবসময় দুবার করে ঘটে। পুকুরে ড়ুবে একজন কেউ মারা গেলে ধরেই নেয়া যায় খুব। শিগগিরই আরেকজন মারা যাবে।
রহমান চাচা খুবই চিন্তিত। রেলে কাটা পড়ে আরেকজন মারা যাবে। সেই আরেকজন কে? ঠাণ্ডা মাথায় হিসাব করলেই বের করা যায়। রহমান চাচা চিন্তিত মুখে হিসেব করেন। দ্বিতীয়জন যে মারা যাবে সে বদরুল স্যারের পরিচিত হতে হবে। সে পুরুষও হবে না। একজন পুরুষের পর একজন নারী, মৃত্যুগুলি এইরকম হয়। এই সব মৃত্যু নারীপুরুষ মিলিয়ে জোড়ায়-জোড়ায় হয় এটাই নিয়ম।
রহমান চাচা আমাকে আড়ালে ডেকে নিয়ে বললেন, তার হিসাবে বলে বদরুল স্যারের পরিবারের ওপর এই ঘটনা ঘটবে।
ঘটনা শেষ পর্যন্ত ঘটল।
ভোর রাতে হইচই চেঁচামেচিতে ঘুম ভেঙ্গে গেল। মগরা ব্রিজের কাছ থেকে চিৎকার আসছে। লোকজন ছুটে যাচ্ছে। মনে হচ্ছে ভয়ংকর কিছু ঘটেছে। ব্রিজটা, কি ভেঙ্গে পানিতে পড়ে গেছে? জাপানি ইঞ্জিনিয়ার বলেছিলেন, ব্রিজের যে অবস্থা যে কোনো মুহূর্তে ভেঙ্গে পানিতে পড়ে যাবে। বিরাট ক্যালামিটি হবে।
কুসুম আপু বলল, টগর দৌড়ে যা, খোঁজ নিয়ে আয় কী হয়েছে। আমি যাবার আগেই রহমান চাচা উপস্থিত হলেন। তার মুখ হাসি হাসি। এই সকাল। বেলাতেই মুখ ভর্তি পান। পানের রস ঠোঁট গড়িয়ে নিচে পড়ছে। রহমান চাচা আনন্দিত গলায় বললেন, বলেছিলাম না ঘটনা ঘটবে। ঘটনা ঘটেছে। আরেকজন মানুষ রেলে কাটা পড়ছে। এক্কেবারে চইদ্দ টুকরা। গোশতের দলা।। চিননের কোনো উপায় নাই।
কুসুম আপু হতভম্ব গলায় বললেন, কে কাটা পড়েছে?
রহমান চাচা পানের পিক ফেলতে ফেলতে বললেন–নাক চ্যাপা চীন দেশের অবিছার স্যার। কই দেশ, আর মরল কই। জম্নের সময়ই নির্ধারণ হয়ে থাকে, কে কই মরব। আমরার করনের কিছুই নাই।
কীভাবে কাটা পড়ল?
সঠিক হিস্টরি কেউ জানে না। মনে হয় ব্রিজে উঠছিল পিসাব করনের জন্যে। এই ব্যাটার অভ্যাস ছিল ব্রিজের উপরে খাড়াইয়া পিসাব করনের। অতি অসভ্য। আমি এখন আবার যাইতেছি আসল খবর আনব। খবর কিছু পাব কিনা বুঝতে পারতেছি না। থানাওয়ালা চইল্যা আসছে। পুলিশ পাহারা বসছে। কাউরে যাইতে দেয় না।
দুর্ঘটনা কীভাবে ঘটল তার নানান কথা শোনা যেতে লাগলো। রাত তিনটার সময় টর্চ হাতে চীনাম্যানকে ব্রিজের দিকে যেতে দেখা গেছে। ক্রেনের ড্রাইভার জমশেদ বলেছে, স্যার কই যান? চীনাম্যান তাকে একটা গালি দিয়ে বলেছে, আমি কোথায় যাই তা দিয়ে তোমার কী দরকার? তারপরই দুর্ঘটনা। এগারো সিন্দুর এক্সপ্রেস ঘটনা ঘটায়।
আরেকটা ভাষ্য হল–ঘটনা কখন ঘটে। কীভাবে ঘটে কেউ জানে না। চীনাম্যান খুব ভোরবেলা ঘুম থেকে উঠেই মগ ভর্তি এক মগ কফি খান। লোকমান বাবুর্চি কফি হাতে ব্রিজের দিকে যায়। সকালবেলা ব্রিজের উপর হাঁটাহাঁটি করাও নাকি উনার অভ্যাস। বাবুর্চি ব্রিজে উঠে চিৎকার দেয়। তার চিৎকার শুনে সবাই ছুটে আসে।।
আমাদের এদিকে রেলের নিচে আগেও মানুষ কাটা পড়েছে। মুহূর্তের মধ্যে হাজার-হাজার মানুষ জড় হয়েছে। কাটা পড়া মানুষের লাশ সরিয়ে নেয়ার সঙ্গে সঙ্গে মানুষজন চলে গিয়ে রেল লাইন আবার ফাঁকা হয়ে গেছে। আজ সে রকম হল না। মানুষ বাড়তেই থাকল। সকাল দশটায় ময়মনসিংহ থেকে রিলিফ ট্রেন চলে এল। ট্রেন লাইন থেকে উল্টে পড়লে রিলিফ ট্রেন আসে। সে-রকম কিছু হয় নি। কিন্তু রিলিফ ট্রেন চলে এসেছে। দুপুরবেলা একটা হেলিকপ্টার নামল আমাদের স্কুলের মাঠে। হেলিকপ্টারে করে দুজন বিদেশী এবং তিনজন বাঙালি নামলেন। বাঙালি তিনজনের একজন আমাদের পরিচিত সেলুন কারে করে এসেছিলেন। লোকজন সব চলে এল হেলিকপ্টার দেখতে। মগরা ব্রিজ খালি হয়ে গেল। আমাদের এ দিকের মানুষ এত কাছ থেকে কখনো হেলিকপ্টার দেখে নি। এত বিরাট একটা জিনিস, কিন্তু দেখাচ্ছে খেলনার মতো। খুব সুন্দর রঙচঙা খেলনা।
কুসুম আপু বলল, আয় তো আমার সঙ্গে। ঘটনা কী জেনে আসি।
আমি বললাম, তোমাকে যেতেই দেবে না। পুলিশ পাহারা। কাউকে যেতে দিচ্ছে না।
তুই আয় আমার সঙ্গে। অবিশ্যিই আমাকে যেতে দেবে।
কার কাছে যাবে? জাপানি ইঞ্জিনিয়ারের কাছে?
হ্যাঁ। বোকা লোক তো, আমার ধারণা সে বিরাট বিপদে পড়তে যাচ্ছে।
কুসুম আপু ঠিকই পুলিশের লোকজন পার হল। তার কোনো অসুবিধা হল না। জাপানি ইঞ্জিনিয়ারকে খুঁজে বের করতেও সমস্যা হল না। তিনি অন্ধকার তাঁবুতে একা-একা চুপচাপ বসে আছেন। হাতে পানির বোতল। চোখ লাল, চোখের কোণে ময়লা জমে আছে। চুল উস্কু খুস্কু। বাকি সবাই নদীর পারে।
নদীতে জাল ফেলা হচ্ছে। চীনাম্যানের শরীরের কাটা বড় অংশই নাকি নদীতে পড়ে গেছে। সেটা তোলার চেষ্টা। হেলিকপ্টার আসা লোকজন নদীর পাড়ে বসে আছেন। তাদের জন্যে চেয়ারের ব্যবস্থা হয়েছে। বাবাকেও দেখলাম তাদের সঙ্গে। বাবার পেট ব্যথাটা যে আবার উঠেছে তা দূর থেকেই বোঝা যাচ্ছে। তিনি উবু হয়ে বসে আছেন। একটু পর পর ঘড়ি দেখছেন। পেটে ব্যথা শুরু হলেই তিনি ঘড়ি দেখেন। ব্যথাটা কখন থাকে মনে হয় তার হিসাব রাখেন।
জাপানি ইঞ্জিনিয়ার মনে হল আমাদের চিনতে পারছেন না। অবাক হয়ে তাকিয়ে আছেন। চোখে পলক পর্যন্ত পড়ছে না। কুসুম আপু বললো, আপনার। কি শরীর খারাপ?