বারান্দায় বাবার ঘরটা খারাপ না। খুব বাতাস আসে। শুধু বর্ষা বাদলার দিনে সমস্যা হয়, বৃষ্টির পানি ঢোকে। বাবা বালিশ হাতে খুবই লজ্জিত ভঙ্গিতে আমাদের ঘরে ঘুমুতে আসেন। ভাইয়ার মেজাজ যেদিন ভালো থাকে সেদিন বাবা আমাদের সঙ্গে ঘুমুতে পারেন। ভাইয়ার মেজাজ খারাপ থাকলে সে রাগী রাগী গলায় বলে, এতটুকু একটা খাটে তিনজন মানুষ ঘুমাব কীভাবে? আমরা কি বামুন?
বাবা মিনমিনে গলায় বলেন, আমি রোগা মানুষ এক হাত জায়গা হলেই হবে। দড়ির মতো পড়ে থাকব। তোরা বুঝতেও পারবি না।
গরমের মধ্যে চাপাচাপি করে ঘুমাতে পারব না।
গরম কই দেখলি? ঝুম ঝুম বৃষ্টি হচ্ছে। কাথা-শীত পড়ে গেছে।
কাঁথা-শীত পড়লে তুমি কাঁথা গায়ে দিয়ে থাক। আমার গরম লাগছে।
বাবা আর কথা বাড়ান না। ছাতা হাতে ইস্টিশনঘরে ঘুমাতে যান। ইস্টিশনঘরে সিন্দুকের মতো বড় একটা বাক্স আছে। সেই সিন্দুকের ওপর পাটি পাতা আছে। বাবাকে মাঝে মধ্যেই সেই সিন্দুকের বিছানায় ঘুমুতে যেতে হয়। ইস্টিশন ঘরটা খারাপ না, শুধু ঘর ভর্তি মাকড়শা। সব সময় দেখা যাবে তিন চারটা বড় বড় মাকড়শা পেটে ডিম নিয়ে ঘুরছে। বাবার ধারণা ইস্টিশন ঘরটা মাকড়শাদের মাতৃসদন। গর্ভবতী সব মাকড়শা ইস্টিশন ঘরে সন্তান খালাস করার জন্যে চলে আসে। আমি মাকড়শা ভয় পাই বলে কখনো বাবার সঙ্গে ইস্টিশন ঘরে ঘুমুতে যাই না।
সবার কথা বলতে গিয়ে আমি দেখি নিজের কথাই বলতে ভুলে গেছি। আমার নাম টগর। আমার জন্মের সময় বাবা ছিলেন বারহাট্টা স্টেশনের স্টেশন মাস্টার। আমাদের রেল কোয়ার্টারে দুটা টগর গাছ ছিল। দুটা গাছেই প্রচুর টগর ফুল ফুটতো। টগর ফুল দেখেই বোধ হয় বাবা আমার নাম রেখেছিলেন টগর। ফুলের নামে ছেলেদের নাম রাখলে তারা মেয়েলি স্বভাবের হয়। সামান্য কিছুতেই পুত পুত করে কাঁদে। কথাটা খুব ঠিক, আমিও কাঁদি। এবার আমি ক্লাস সিক্সে উঠেছি। রেজাল্ট আউটের দিন আমাদের ক্লাস টিচার বদরুল স্যার আমাকে হেডস্যারের কাছে নিয়ে গিয়ে বললেন, ভেরি ব্রিলিয়ান্ট। অংকে। একশতে একশ পেয়েছে। এক নম্বর কাটা যায় নাই।
হেডস্যার হাই তুলতে তুলতে বললেন, ও।
বদরুল স্যার আমার দিকে তাকিয়ে আদুরে গলায় বললেন, হাঁদার মতো দাঁড়িয়ে আছিস কেন? হেড স্যারকে কদমবুসি করে দোয়া নে। গাবগাছ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকলে হবে? দোয়া নিবি না?
আমি কদমবুসি করলাম। হেডস্যার বিরস গলায় বললেন, মন দিয়ে।
লেখাপড়া করবি। Knowledge is power মনে থাকে যেন। Knowledge বানান কর দেখি।
আমি নলেজ বানান করলাম। হেডস্যার বললেন, রাস্তাঘাটে যদি কোনো দিন দেখি হাতে বিড়ি সিগারেট তাহলে কিন্তু টান দিয়ে কান ছিড়ে ফেলব। ছেড়া কান পার্সেল করে মক্কা শরীফে পাঠিয়ে দেব। যা এখন।
বদরুল স্যার আমাকে নিয়ে বের হয়ে এলেন। তিনি অবিশ্যি আমাকে ছেড়ে দিলেন না। নিয়ে গেলেন এসিসটেন্ট হেড স্যারের ঘরে। ঠিক আগের মতো গলায় বললেন, ভেরি ব্রিলিয়ান্ট অংকে একশতে একশ পেয়েছে। এক নম্বরও কাটা যায় নাই। চৌবাচ্চার অংকটা কেউ রাইট করতে পারে নাই। সে রাইট করেছে।
এসিসটেন্ট হ্যাডস্যার হাই তুলতে তুলতে বললেন, কার ছেলে?
স্টেশন মাস্টার সাহেবের ছেলে। যে সেকেন্ড হয়েছে তার সাথে এই ছেলের একশ আঠারো নম্বরের ডিফারেন্স।
এসিসটেন্ট হেড মাস্টার সাহেব বিরক্ত গলায় বললেন, মুসলমানের ছেলে–জাত সাপ হয়ে জন্মায়। কিছুদিন পরেই হয়ে যায় ঢোঁরা সাপ। বিষের কারবার নাই। শুধুই ডােরাকাটা। শুধুই ফোঁসফোঁস। দেখবেন এক চান্সে এস এস সি পাস করবে না। অংকে একশ পেয়েছে বললেন না? গোল্লা খাবে সেই অংকে। আমার কথা বিশ্বাস না হলে লিখে রাখেন। অনেক তো দেখলাম।
বদরুল স্যার এসিসটেন্ট হেডস্যারের কথায় মন খারাপ করলেন। তবে দমলেন না। আমাকে নিয়ে গেলেন টিচার্স কমন রুমে। তখন কী জন্যে জানি
আমার চোখে পানি আসি পানি আসি ভাব হল। ফুলের নাম রাখার এই সমস্যা, কারণ ছাড়াই চোখে পানি আসবে। বদরুল স্যার থমথমে গলায় বললেন, ছাগলের মতো কাঁদছিস কেন? খবর্দার কাঁদবি না। বেটাছেলেদের জীবনে একবার মাত্র কাঁদার পারমিশন আছে। Only once. সেই একবারটা একেক জনের জন্যে একেক রকম। কান্না বন্ধ কর। চোখ মুছ।
তিনি পকেট থেকে একটা এক টাকার নোট বের করে বললেন, যা বাদাম কিনে খা। আর শোন বাড়িতে গিয়ে বাবা মা সবাইকে কদমবুসি করে দোয়া নিবি। মুরুব্বিদের দোয়া হল লাইফ জ্যাকেটের মতো। লাইফ জ্যাকেট ছাড়া সমুদ্র পার হওয়া যায় না। দুনিয়াটা হল সমুদ্র। আমি তোর অংক খাতা দেখে খুবই খুশি হয়েছি। আজকে আছরের নামাজের সময় তোর জন্যে খাস দিলে দোয়া করবো। আছর ওয়াক্তের দোয়া কোনোসময় বিফল হয় না। কারন আছর ওয়াক্তে ইউনুস নবী মাছের পেট থেকে নাজাত পেয়েছিলেন এবং আছর ওয়াক্তেই কেয়ামত হবে।
বদরুল স্যারকে আমি খুব পছন্দ করি। শুধু আমি একা না, স্কুলের সব। ছাত্র পছন্দ করে। অথচ তিনিই এই স্কুলের সবচে রাগী স্যার। তিনি অনেক ধরনের ধমক দিতে পারেন। তাঁর সবচে কঠিন ধমকের নাম–পিসাব ধমক। এই ধমক যে খায় সে প্যান্ট ভিজিয়ে ফেলে। আবার এমনও ইতিহাস আছে যাকে পিসাব ধমক দিয়েছেন তার কিছু হয় নি কিন্তু তার পাশে বসা ছাত্রের কারবার হয়ে গেছে।
বদরুল স্যারেরও আমার মার মতো সমস্যা আছে। স্কুলের বাইরে কোনো ছাত্রকে তিনি চিনতে পারেন না। সালাম দিলে মাথা ঝুকিয়ে সালাম নেন মুখের দিকে তাকান। বিড়বিড় করেন কিন্তু চিনতে পারেন না। একবার আমি রাস্তায় স্যারকে সালাম দিলাম। স্যার সঙ্গে সঙ্গে বললেন–ওয়ালাইকুম সালাম। জি আমি ভালো আছি।