পানি খেয়ে বাবার পেটের ব্যথা মনে হয় কিছু কমেছে। তিনি নিজে নিজেই উঠে দাঁড়ালেন। ইষ্টিশনের দিকে হাঁটতে শুরু করলেন। কেমন এলোমেলো ভঙ্গিতে পা ফেলছেন। মনে হচ্ছে এক্ষুনি পায়ের সঙ্গে পা লেগে তিনি আছাড় খেয়ে পড়বেন। ভাইয়া বলল, বাবার শরীরটা অতিরিক্ত খারাপ করেছে। চিকিৎসা হওয়া দরকার। বাবাকে ঢাকা নিয়ে গেলে কেমন হয়?
আমি বললাম, ভালোই হয়।
কুসুমের টাকাটা আছে। দোকান কিছু পরে হোক। আগে বাবার চিকিৎসা হোক।
রহমান চাচা বললেন, স্যারের পিছনে টাকা খরচ করা ঠিক না। উনাকে মৃত্যু ব্যধিতে ধরেছে। এই রোগের চিকিৎসা নাই। খামাখা টাকা নষ্ট। টাকা খুবই জটিল জিনিস। বিনা কারণে টাকা নষ্ট করা ঠিক না। হাদিসে আছে যে অকারণে টাকা নষ্ট করে সে শয়তানের ভাই।
ভাইয়া কঠিন গলায় বলল, রহমান চাচা সব কিছু নিয়ে কথা বলবেন না।
রহমান চাচা উদাস ভঙ্গিতে বললেন, সব কিছু নিয়া তো কথা বলি না। স্যারের বিষয়ে বলি। স্যারের বিষয়ে আমি যদি কথা না বলি কথাটা বলবে কে?
মা যখন আমাদের সঙ্গে ছিলেন তখন বাবা মাঝে-মধ্যে রাতে বাসায় ঘুমুতেন। এখন মার ঘরটা খালি। ঘুমুবার জায়গার অভাব নাই, কিন্তু বাবা রাতে থাকেন ইস্টিশনে। মার ঘরে তিনি ঘুমুতে পারেন না। তার নাকি গা ছমছম করে। রাতে ঘুম ভাঙ্গলে মনে হয়, বিছানার চারপাশে কে যেন হাঁটাহাঁটি করছে। খালি পায়ের হাঁটার শব্দ। যে হাটে অন্ধকারে হাড়িপাতিলের সঙ্গে মাঝে মাঝে তার পায়ের ধাক্কা লাগে। ঝনঝন করে হাড়িপাতিল চারিদিকে গড়িয়ে পড়ে। তখন বাতি জ্বাললে দেখা যায় সব হাড়িপাতিল জায়গা মতোই আছে। একটাও নড়ে নি।
মার খালি ঘরে কুসুম আপু এখন আমাকে নিয়ে ঘুমায়। এতে অনেক সুবিধাও হয়েছে। জাপানি ইঞ্জিনিয়ার ভাইয়ার ঘরে একা ঘুমুতে পারেন। ভাইয়া আগে তার বন্ধুর বাড়িতে ঘুমুতে যেত। এখন ইস্টিশনে ঘুমুতে যায়। সে অবিশ্যি বাবার সঙ্গে ঘুমায় না। রহমান চাচার সঙ্গে ঘুমায়। বাবার শরীর ভালো না। কখন কী লাগে।
কুসুম আপু ঘুমুতে যাবার আগে অনেকক্ষণ আমার সঙ্গে গল্প করেন। তারপর বলেন, আর কোনো কথা না এখন ঘুমের ভান করে মটকা মেরে পরে থাকবি। কোনো শব্দ করবি না। ঘুমিয়েও পড়বি না। জেগে থাকবি। আজ আমরা ভূত ধরব। খাটের চারপাশে যে হাঁটাহাঁটি করে তাকে হাতে নাতে ধরা হবে। আমরা জেগে থাকলে সে আসবে না।
ভূত কোনোদিন ধরা যায় না।
ধরা না গেলে, না যাবে। সত্যি সত্যি ভূত বলে কিছু আছে, সেই ভূতই খাটের চারপাশে ঘুরে এই প্রমাণ পেলেই আমি খুশি।
কোনো-কোনো রাতে কুসুম আপুর মেজাজ অত্যন্ত ভালো থাকে। মনে হয় আনন্দ তিনি ধরে রাখতে পারছেন না। তখন সত্যি করে আমি বলে ফেলি, আপু ঐ চিহ্নটা আমাকে দেখাবে না?
কুসুম আপু অস্বাভাবিক গম্ভীর হয়ে বলে, কোন চিহ্ন? লাল তিলটার কথা বলছিস?
হুঁ। যার জন্যে সব পুরুষ তোমার কথা শুনে।
মাথা থেকে এটা দূর করতে পারছিস না? বললাম তো দেখাব। আজ না। এখন ঝিম ধরে পড়ে থাক। দেখি ভূতের হাঁটাহাঁটি শোনা যায় নাকি।
তোমার বিয়ে কি জাপানি ইঞ্জিনিয়ারের সঙ্গে হবে?
জানি না কার সঙ্গে হবে। কাউকেই আমার পছন্দ হয় না। আবার। সবাইকেই পছন্দ হয়। তোকেও হয়।
আমি তো খুবই ছোট।
সারাজীবন তো ছোট থাকবি না। একদিন হঠাৎ বড় হয়ে যাবি। মানুষ কখনো আস্তে বড় হয় না-হঠাৎ বড় হয়ে যায়।
কীভাবে?
বলতে পারব না কীভাবে। আর একটা শব্দ করলে পাখা দিয়ে মাথায় বাড়ি দেব। চোখ বন্ধ করে শুয়ে থাক। কিন্তু ঘুমাবি না। খবর্দার ঘুমাবি না। আজ ভূত কিংবা ভূততি যাই হোক আমারা হাতে নাতে ধরব।
কুসুম আপু একটা কথা শুধু জিজ্ঞেস করি।
কী কথা?
ধলা সামছুর বৌ উনার মধ্যেও কি ঐ চিহ্নটা আছে?
এই কথা কেন বললি?
তার কাছে যে পুরুষ যায়, সেই বার-বার যায়। আর ফিরতে পারে না। আমাদের বদরুল স্যার গিয়েছিলেন- এখন নাকি বার-বার যান।
তোদের স্কুলের বদরুল স্যার?
হুঁ।
তোকে কে বলেছে?
সবাই বলে। স্যার এখন আর স্কুলে আসে না।
কুসুম আপু অন্ধকারেই তালপাখা দিয়ে মাথায় প্রচন্ড একটা বাড়ি দিয়ে বলল, আর একটা কথাও না।
আমি চোখ বন্ধ করে শুয়ে থাকি। শুয়ে থাকতে থাকতেই এক সময় ঘুমিয়ে পড়ি।
আমাদের স্কুল ছুটি হয়ে গেল
এসেমব্লির পর পর আমাদের স্কুল ছুটি হয়ে গেল। মেট্রিকের রেজাল্টের পর আমাদের স্কুল সবসময়ই একদিনের ছুটি হয়। ভালো রেজাল্টের ছুটি। আজকেরটা তেমন না। আজ স্কুল ছুটি হয়েছে কারণ বদরুল আলম স্যার মারা গেছেন। রোগে শোকে মৃত্যু না–রেলে কাটা পড়ে মৃত্যু। তিনি রেল লাইনে মাথা দিয়ে শুয়েছিলেন। ধড় থেকে মাথা আলাদা হয়ে গেছে। হেড স্যার এসেমব্লিতে বক্তৃতা দিলেন।
বদরুল আলম সাহেব এই স্কুলের আদর্শ শিক্ষক ছিলেন। দীর্ঘ তেইশ বছর তিনি। অতি নিষ্ঠার সঙ্গে শিক্ষকতা করেছেন। তার মৃত্যুতে স্কুল একজন নিবেদিত প্রাণ শিক্ষক হারিয়েছে। এই ক্ষতি পূর্ণ হবার না। যাই হোক এখন অন্য একটা প্রসঙ্গ, বদরুল আলম সাহেব সম্পর্কে কিছুদিন ধরে সামান্য দুঃখজনক কথাবার্তা শোনা গেছে। সবই রটনা। রটনায় সত্যতার লেশমাত্রও নাই। এই জাতীয় দুঃখজনক রটনা যেন প্রশ্রয় না পায় সে দিকে লক্ষ্য রাখতে হবে। সম্মানিত লোকের সম্মান রক্ষা করা আমাদের সকলের কর্তব্য।…
বদরুল স্যারকে নিয়ে কানাঘুষা অনেক দিন থেকেই শোনা যাচ্ছিল। তিনি নাকি খারাপ জায়গায় ঘোরাঘুরি করেন। অনেকেই দেখেছে। সবদিন না, বুধবার রাতে তিনি নাকি ধলা সামছুর বৌ এর ঘরে যাবেনই। এ জাতীয় গুজবের কথা। যেই শুনে সেই রেগে উঠে। ধমকের গলায় বলে- একজন মানী লোক সম্পর্কে এইসব কী কথা? ছিঃ। বদরুল স্যারকে আমরা চিনি না। ঘর সংসার আছে। সুখী সংসার। এক মেয়ের বিবাহ হয়েছে, আরেকটা মেয়ে বিবাহের উপযুক্ত হয়েছে… তাকে নিয়ে এইসব কী কথা। এইগুলা আর কিছুই না। কিয়ামতের নিশানা। কিয়ামতের আগে আগে মানী লোক মান হারায়। দুষ্ট লোক মান পায়।।