বাবার পেটে ব্যথা সেরে গেল। তিনি গা ঝাড়া দিয়ে উঠে বসলেন। জাপানি ইঞ্জিনিয়ার যে ব্যস্ততা দেখালেন তাও দেখার মতো। এত বড় সুসংবাদ নিয়ে লোকজন আসছে তাদের শুধু মুখে দেয়া যায় না। তিনি আমাকে নিয়ে মিষ্টি আনতে গেলেন। শুধু মিষ্টি না, চা পাতা, চিনি এবং চায়ের দুধও কেনা হল। এবং জাপানি ইঞ্জিনিয়ার নিজেই চা বানাতে রান্না ঘরে ঢুকে গেলেন। রহিমা ফুপু একবার শুধু বলেছিলেন—ছিঃ ছিঃ আপনি কেন? জাপানি ইঞ্জিনিয়ার গম্ভীর মুখে বললেন, আপনি শুধু দেখুন। চা আম ভালোই বানাতে পারি। একা। একা দীর্ঘদিন চা বানিয়ে এমন এক্সপার্ট হয়েছি। হা হা হা। জাপানে আমি একবার কম্পিটিশনে চা বানিয়ে ফার্স্ট প্রাইজ পেয়েছিলাম।
শ্রীলংকার এক ছেলে, আমি, পাকিস্তানের একজন, ইন্ডিয়ার মাদ্রাজের একজন, আরেকজন জাপানি মেয়ে এই পাচজনের মধ্যে কম্পিটিশন। যার চা সবচে ভালো হবে সে পাবে এক হাজার ইয়েন। জাজ ছিলেন ব্রিটিশ এক ভদ্রলোক। এক হাজার ইয়েন আমিই পেয়েছিলাম।
অন্য সময় জাপানি ইঞ্জিনিয়ার মিনিটে মিনিটে কুসুম আপুর খোঁজ করেন। আজ তা করছেন না। মহানন্দে চা বানাচ্ছেন। আমি তার হেল্পার। আজ আমার সঙ্গেই গল্প করছেন। আগ্রহ নিয়েই গল্প করছেন। গল্পের বিষয়বস্তু অবশ্য কুসুম আপু।
বুঝলে টগর, তোমার বোন যখন ব্রিজের উপর থেকে ঝাঁপ দিল তখনি আমি বুঝেছি এই মেয়ে সাধারণ মেয়ে না। এ মেয়ে হল মাকিউকি টাইপ। মাকিউকি কি তাতো জান না। মাকিউকি হল যারা প্রতিভা জনিত কারণে একসেন্ট্রিক। মাকিউকি একটা জাপানি শব্দ। ভালো কথা একসেন্ট্রিক শব্দের মানে জান? একসেন্ট্রিক ইংরেজি শব্দ—এর মানে বায়ুগ্রস্ত। ঠিক পাগল না, আবার ঠিক সুস্থও না। ছোটদের সঙ্গে গল্প করার এই হল সমস্যা। প্রতিটি স্টেপ ব্যাখ্যা করে করে এগুতে হয়। গল্পের মূল ফ্লো যায় নষ্ট হয়ে। আমি কি ঠিক করেছি জান? আমি ঠিক করেছি কুসুমকে ম্যাথমেটিক্স পড়াব। ম্যাথ বিষয়ে সবার মধ্যে অকারণ ভীতি কাজ করে। ভালো ছেলেমেয়েরা আবার অন্যদের কাছে শুনে কম্পিউটার সায়েন্স এস্ট্রোফিজিক্স এইসব পড়তে চায়। সায়েন্সের মূল বিষয় হল ম্যাথ।
জি।
যদিও ম্যাথ কিন্তু বিজ্ঞান না। এই ভুলটা সবাই করে। ম্যাথ বললেই মনে করে সায়েন্স। ম্যাথ হল বিজ্ঞানকে বোঝার একটা টুল। টুল মানে জান?
জি না। টুল মানে যন্ত্রপাতি।
ও।
কুসুমের সঙ্গে কথা বলতে হবে, দেখি সে রাজি হয় কিনা। অবশ্য আমি যা বলব তাতেই সে রাজি হবে।
না, রাজি হবে না। উল্টো হবে। কুসুম আপু যা বলবে তাতেই আপনি রাজি হবেন।
কেন?
কারণ কুসুম আপুর শরীরে একটা বিশেষ চিহ্ন আছে। এই চিহ্ন যার শরীরে থাকে সব পুরুষ তার কথা শুনে।
তোমাকে কে বলেছে?
কুসুম আপু।
চিহ্নটা কী?
চিহ্নটা কী আপনাকে বলা যাবে না।
জাপানি ইঞ্জিনিয়ার সাহেবের বোধ হয় সারারাত গল্প করার পরিকল্পনা ছিল। তিনি তা করতে পারলেন না। সাইট থেকে তাকে নেবার জন্যে লোক। এসেছে। চীনাম্যানের সঙ্গে ক্রেইনের ড্রাইভার জমশেদের কী নাকি গন্ডগোল হয়েছে। সিরিয়াস ঝামেলা হচ্ছে। তিনি না গেলেই না।
এত বড় একটা পাশ করার পরেও কুসুম আপু খুব স্বাভাবিক। যেন তার কিছুই হয় নি। রহিমা ফুপু বললেন, কিরে মেডেলটা খুলে রাখলি কেন। গলায় দে।
কুসুম আপু বলল, আমি কি বিড়াল যে গলায় ঘন্টা বেঁধে ঘুরব।
এটা সোনার মেডেল এটা ঘন্টা নাকি?
কুসুম আপু আমাকে ঘুম থেকে তুলল। ফিস ফিস করে বলল, আজ একটা আনন্দের ঘটনা ঘটেছে সেই উপলক্ষে তোকে আমি আমার চিহ্নটা দেখাব। কি দেখতে চাস? ভ্যাবদার মতো বসে থাকবি না। দেখতে চাইলে মাথা নাড়।
আমি হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়লাম।
কুসুম আপু সঙ্গে সঙ্গে বলল, আজ না আরেক দিন।
মাকে হাসপাতালে ভর্তি করিয়ে
মাকে হাসপাতালে ভর্তি করিয়ে ভাইয়া ফিরে এসেছে। ভর্তির ব্যাপারে কোনো সমস্যা হয় নি। জাপানি ইঞ্জিনিয়ারের বন্ধু সব করিয়ে দিয়েছেন। এবং ভাইয়াকে ডেকে বলেছেন, তুমি কোনো দুশ্চিন্তা করবে না। তোমার মায়ের ভালো চিকিৎসা হবে। তার অবস্থার উন্নতি অবনতি যাই হয় আমরা চিঠি দিয়ে জানাব। হাসপাতালের খাওয়া দাওয়ার সমস্যা আছে। করার কিছু নাই। হেড আয়াকে কিছু টাকা পয়সা দিয়ে যাও, বাইরে থেকে এটা সেটা কিনে খাওয়াবে। এদেরকে হাতে রাখা ভালো। রোগীর আসল দেখাশোনা এরাই করে।
ভাইয়া হেড আয়ার হাতে পাঁচশ টাকা এবং হেড নার্সের হাতে পাঁচশ টাকা দিয়ে এসেছে। বাবা বললেন, এত টাকা তুই পেয়েছিস কোথায়?
অফিসের টাকা। অফিসের বারোশ টাকা আমার কাছে ছিল।
আমার কাছ থেকে টাকাটা নিয়ে দিয়ে আয়।
ভাইয়া বলল, আচ্ছা।।
অফিসে টাকা ফেরত দেওয়ার ব্যাপারে তার কোনো আগ্রহ দেখা গেল না। অফিসে যাবার ব্যাপারে তার আর উৎসাহ নেই। অনেক বেলা পর্যন্ত ঘুমায়। ঘুম থেকে উঠে রেস্টুরেন্টে যায় চা খেতে। চা খেয়ে চলে আসে ইস্টিশনে। ইস্টিশনে এসে রেল লাইনে পা রেখে ঝিম ধরে বসে থাকে। দূর থেকে দেখলে মনে হয় টেলিগ্রাফের তারে কাক বসে আছে। কাকরা যেমন মাথা ঝাঁকায়, ভাইয়াও মাথা ঝাঁকায়।
রহমান চাচার ধারণা রেল লাইনে বসে থাকা খুবই অলক্ষণ। কেউ ঘন-ঘন রেল লাইনে বসলে রেল লাইন তাকে চিনে ফেলে। নিশি রাতে ডাকাডাকি শুরু করে। রেল লাইনের ডাক, নিশি ডাকের মতোই মারাত্মক। রেল লাইন। মানুষটাকে ডেকে ঘর থেকে বের করবে। তারপর ভুলিয়ে ভালিয়ে কোনো এক নিশুতি রাতে তাকে কাছে টানবে। বেচারা ঘোরের মধ্যে লাইন ধরে হাঁটতে থাকবে, বুঝতেও পারবে না পেছন থেকে ঝড়ের গতিতে আসছে চিটাগাং মেইল, কিংবা বাহাদুরাবাদ এক্সপ্রেস। সে ট্রেনের শব্দ ঠিকই শুনবে, কিন্তু ভাববে বাতাসের শব্দ। ট্রেনের ড্রাইভার যখন বাঁশি বাজাবে সেই শব্দও তার কানে যাবে। কিন্তু সে ভাববে বনের ভেতর থেকে শীস-পাখি শীস দিচ্ছে। শীসপাখিরা ট্রেন লাইনের আশেপাশে বনজঙ্গলে থাকে। তারা অবিকল রেল ইঞ্জিনের বাঁশির মতো শীস দেয়।