মার কথাবার্তার কোনো ঠিক ঠিকানা না থাকলেও তিনি তাঁর দুই ভাইকে দেখার পর থেকেই খুব স্বাভাবিক আচরণ করছেন। চিৎকার হই চই নেই। ঘোমটা দিয়ে বসে আছেন। বাবা যখন বললেন—বৌ যাও কয়েকটা দিন বেড়ায়ে আস। মা সঙ্গে-সঙ্গে সুবোধ বালিকার মতো ঘাড় নাড়লেন। এবং ফিক করে হেসে ফেললেন।
রহিমা ফুপু মার সব কাপড় চোপড় গুছিয়ে দিয়েছেন। মার সুটকেসে বাবা কিছু টাকাও দিয়ে দিয়েছেন। টাকা, চিঠি লেখার পােস্ট কার্ড। বল পয়েন্ট কলম।
বৌ মনে করে চিঠি লিখবে। তোমার লিখতে ইচ্ছা না করলে, হাসপাতালে ডাক্তার আছে, নার্স আছে। তাদেরকে বললেই চিঠি লিখে দিবে। পােস্ট কার্ডে ঠিকানা লেখাও আছে।
জি আচ্ছা।
খাওয়া দাওয়া ঠিক মতো করবা। অষুধ পত্র খাবার ব্যাপারে অনিয়ম করবা না।
জি আচ্ছা।
সময় সুযোগ হলেই তোমাকে দেখতে যাব। প্রতি মাসেই কেউ-না-কেউ যাবে। কোনোবার আমি, কোনোবার যাবে রঞ্জু।
জি আচ্ছা।
ট্রেন বিকেলে। দুপুরের পর থেকে মাকে খুব খুশি-খুশি লাগতে লাগল। তিনি কারো সঙ্গে কোনো কথা বলছেন না, কিন্তু সবার দিকেই হাসি মুখে তাকাচ্ছেন। তাঁর চোখ দেখে মনে হচ্ছে তিনি সবাইকে চিনতে পারছেন। আমি কাছে গিয়ে বললাম, মা আমাকে চিনেছ?
মা হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়লেন। আমি বললাম, বলতো আমি কে?
মা বললেন, তুই টগর।
তোমার মাথার যন্ত্রণা কি কমে গেছে?
হ্যাঁ।
তুমি কোথায় যাচ্ছ জান?
পদ্মনগর।
তুমি পদ্মনগর যাচ্ছ না মা, তোমাকে হাসপাতালে নিয়ে যাচ্ছে। ওরা তোমার চিকিৎসা করবে। তুমি ভালো হয়ে ফিরে আসবে।
আচ্ছা।
আমি মার গা ঘেঁসে বসে রইলাম। খুব কাছে বসলাম যেন ইচ্ছা করলেই মা আমার গায়ে হাত রাখতে পারেন। মা তা করলেন না। চুপচাপ বসে রইলেন, তবে মাঝে মধ্যেই কৌতূহলী চোখে আমার দিকে তাকাতে লাগলেন। তাঁর ঠোঁটে ফিক ফিক হাসি লেগেই রইল।
দুপুরে খেতে বসে দুই মামার ভেতর কী নিয়ে যেন লেগে গেল। চাপা গলায় একজন আরেকজনের সঙ্গে কথা বলছেন, কটমট করে তাকাচ্ছেন। ভয়ংকর কিছু হচ্ছে তা বোঝা যাচ্ছে, কিন্তু তার ফাঁকে খাওয়াদাওয়া ঠিকই করছেন। এক ভাই আবার আরেক ভাইকে সাধাসাধিও করছেন—মাছ নিবা আরেক পিস?
আমি কৌতূহলী হয়ে একবার জিজ্ঞেস করলাম, মামা কী হয়েছে? হারুন মামা মধুর ভঙ্গিতে হাসতে হাসতে বললেন, কিছু না বাপধন। সংসারী আলাপ। সংসারী আলাপে একটু আধটু হিট হয়। এইটা কিছু না।
সংসারী আলাপের রহস্য কিছুক্ষণের মধ্যেই জানা গেল। হারুন মামা খাওয়া শেষ করে পান মুখে দিতে দিতে বাবাকে বললেন, দুলাভাই বুবুর যাতায়াত এবং চিকিৎসার খরচা আপনে বড় ভাই এর হাতে দিয়েছেন। এইটা ঠিক না। আমরা দুই জনে বুবুরে নিয়া যাইতেছি। খরচা সমান দুই ভাগ কইরা দুইজনের হাতে দেন।
বাবা বললেন, একজনের কাছে দিলেই তো হয়।
হারুন মামা বললেন, হয় না। সংসার অত সহজ না। বড় ভাই এর কাছ থাইক্যা দুইটা টাকা বাইর করা আমার পক্ষে সম্ভব না। বাকি আপনার বিবেচনা। আমি আমার ব্যবসা বাণিজ্য সব ফালাইয়া রওনা হইছি আর টেকা বগলে নিয়া বইস্যা আছে আরেকজন। এই রকম হইলে তো আমার যাওয়া। সম্ভব না। আমারে বিদায় দেন।
এইসব কী বলছ?
আমি পরিষ্কার মানুষ। আমার পরিষ্কার কথা। খরচার টেকা দুই ভাগ হবে। সমান সমান ভাগ। যদি তা হয় আমি আছি। যদি না হয়—থুক্কু।
বোনের জীবন মরণ সমস্যা আর তুমি বলে ফেললে–থুক্কু।
হারুন মামা আরেকটা পান মুখে দিতে দিতে বললেন, আমি পরিষ্কার মানুষ। পরিষ্কার কথা বললাম। এখন জামানা খারাপ। পরিষ্কার কথা কারোর ভালো লাগে না।
বাবা এই ঝামেলা কীভাবে মেটালেন আমি জানি না। দেখা গেল দুই ভাইই অত্যন্ত আনন্দিত মুখে বোনকে নিয়ে ট্রেনে উঠলেন। হারুন মামা ট্রেনের জানালা থেকে গলা বের করে বললেন। দুলাভাই লিশ্চিন্ত থাকেন। আমরা দুই ভাই থাকতে কোনো অসুবিধা হবে না বাকি আল্লাহপাকের মর্জি।
ট্রেনে উঠে মার আনন্দ খুব বাড়ল। তাঁর মুখে পান। একটু পর-পর তিনি জানালা দিয়ে মুখ বের করে পানের পিক ফেলছেন, এবং ছোট বাচ্চাদের মতো হাসছেন।
মাকে বিদায় দিতে আমরা সবাই ইস্টিশনে এসেছি। বাবা দাঁড়িয়ে আছেন কুঁজো হয়ে। দুপুরের পর থেকে তাঁর পেটে ব্যথা শুরু হয়েছে। আজকের ব্যথাটা মনে হয় তীব্র। কারণ তাঁর মুখ কালো হয়ে গেছে। তিনি একটু পর পর হাতঘড়িতে সময় দেখছেন। ব্যথা উঠলেই তিনি ঘড়ি দেখেন। বাবার পাশে রহমান চাচা দাঁড়িয়ে আছেন। রহমান চাচা বাবার কানে-কানে কি যেন বলছেন। বাবা ক্লান্ত ভঙ্গিতে হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়ছেন। রহিমা ফুপু একটু দূরে একা দাঁড়িয়ে আছেন। সব সময় তার মাথায় ঘোমটা থাকে। আজ তার মাথায় ঘোমটা নেই। আমি দাঁড়িয়ে আছি কুসুম আপুর পাশে। কুসুম আপুর চোখ দিয়ে ক্রমাগত পানি পড়ছে। কুসুম আপু এত কাঁদছে কেন আমি বুঝতে পারছি না। মার সঙ্গে তার কখনোই কোনো খাতির ছিল না। মা যখন সুস্থ থাকেন তখনও কুসুম আপুর সঙ্গে কথা বলতেন না। বরং তাকে দেখলে মার ভুরু সামান্য কুঁচকে যেত। চোখের দৃষ্টি কঠিন হয়ে যেত।
ভাইয়ার ইস্টিশনে আসার কথা না। বুড়ি মিস এলেনের সঙ্গে তার প্রোগ্রাম। কিন্তু ভাইয়া ঝড়ের বেগে সাইকেল চালিয়ে উপস্থিত হল। মনে হয় সে অনেক দূর থেকে এসেছে আর শার্ট ঘামে ভেজা। চোখ লাল। বড় বড় নিঃশ্বাস নিচ্ছে।
ভাইয়াকে দেখে বাবা অসম্ভব খুশি হলেন। মনে হল হঠাৎ তাঁর পেটের ব্যথাটা কমে গেছে। তিনি ভাইয়ার দিকে তাকিয়ে হাসি মুখে বললেন, বাবা যাও। মাকে কসমবুসি করে আস। ট্রেন এখন ছেড়ে যাবে। এম্নিতেই দুই মিনিট বেশি রেখেছি।