প্রতিদিনই এই বুড়ির গল্প না বললে ভাইয়ার মনে হয় অস্থির লাগে। আমি সব গল্পই আগ্রহ করে শুনি। বুড়ি মিস এলেনের গল্প শুনতেও আমার ভালো লাগে।
বুঝলি টগর। বুড়ির স্বাস্থ্য দেখে বোঝার উপায় আছে যে চার মাইল কাদা মাখা রাস্তা সে জোর কদমে হাঁটতে পারে? আমি একেবারে থান্ডার হয়ে গেছি। হাসে আর ফুস ফুস করে সিগারেট খায়। খুবই লজ্জার কথা—একদিন আবার আমাকে সাধল। আমি মিথ্যা করে বললাম– ডােন্ট স্মােক।
তোমাকে মনে হয় খুব পছন্দ করে।
পছন্দ তো করেই। এটা নিয়ে হয়েছে সমস্যা, বাংলাদেশের কারবার। কেউ কারো ভালো দেখতে পারে না। অফিসে যেই টের পেয়ে গেল মিস এলেন আমাকে পছন্দ করেন। ওমি দলাদলি। ছগির বলে অফিসে খানকির পুলা আছে। আমার বদলে মিস এলেনের ডিউটি তাকে করতে দিল।
সে কী।
কোনো লাভ হয় নি। মিস এলেন পরিষ্কার বলে দিলেন—রন্টু কুটায়? রন্টু। বিদেশীদের জিব্ব্যা ভারী থাকে এরা কঠিন বাংলা শব্দ বলতে পারে না। আমাকে ডাকে রন্টু।
বাংলা জানেন?
ভালো বাংলা জানে। মাঝে মাঝে উনার বাংলা শুনে আমি থান্ডার হয়ে যাই। ঐ দিন কি হয়েছে শোন—এক বাড়িতে গিয়েছি। বাড়ির ভেতর থেকে এক লোক বের হয়ে বলল, বুইড়া মাগী কী চায়? মিস এলেন তার কথা শুনে শান্ত গলায় বললেন—মহিলাকে মাগী বলিবে না। মাগী গালাগালি ভালো নহে। ইহা অশোভন গালাগালি।
উনি তো দেখি ভালো বাংলা শিখেছেন।
বিদেশী তো। এরা ইশারাতেই সব ধরে ফেলে। আমরা ডালে ডালে চললে ওরা চলে পাতায় পাতায়। আমরা পাতায় পাতায় চললে ওরা চলে শিরায় শিরায়।
তোমার কাজে উনি খুব খুশি?
ওদের খুশি-অখুশি বোঝা মুশকিল। খুশি হলেও এরা কিছু বলবে না, আবার অখুশি হলেও কিছু বলবে না। তবে আমাকে যে অত্যন্ত স্নেহ করে এটা বোঝা যায়।
কীভাবে বুঝলে? তোমাকে কিছু বলেছেন?
আমাকে নিয়ে একটা ছড়া বানায়ে ফেলেছে—বুঝলি না।
কী ছড়া?
সাইকেল নিয়ে বের হই–টুনটুন করে ঘন্টা বাজাই সেটা নিয়ে ছড়া
সাইকেল টিং টিং
রন্টু পাগলা শিং
হা হা লাফটার
রন্টু বিগ স্টার।
মার চলে যাবার দিন ভাইয়া থাকতে পারল না। মিস এলেনকে নিয়ে তার। মুলাদী গ্রামে প্রোগ্রাম। সেই গ্রামে পনেরো জনকে সেনিটারি পায়খানা দেয়া হবে। গর্ত করে রিং স্ল্যাভ বসানো হবে। একজন বয়াতীকে আনা হয়েছে সে তার দলবল নিয়ে স্যানিটারি পায়খানার উপকারিতা নিয়ে গান করবে। পুরো অনুষ্ঠান ভিডিও করা হবে। বিরাট ব্যবস্থা। স্যানিটারি পায়খানার গানের একটা ক্যাসেট ভাইয়া নিয়ে এসেছে। জাপানি ইঞ্জিনিয়ার সাহেবের ক্যাসেট প্লেয়ারে বাজিয়ে সেই গান আমরা শুনেছি। ভাইয়া চোখ বড় বড় করে বললবাংলাদেশের গ্রামে গঞ্জে এই গান আমরা ছড়িয়ে দেব। একটা হুলুস্থুলুস পড়ে যাবে। ভাইয়া হুলুস্থুল বলতে পারে না। বলে হুলুস্থুলুস। বুঝলি টগর, লোকের মুখে মুখে গান ফিরবে। আমাদের কর্ম পদ্ধতি মারাত্মক। গানের মাধ্যমে শিক্ষা। ভাইয়া এমন ভাবে কথা বলে যেন গানটা সে নিজেই গেয়েছে। এবং এই গান গ্রামে গঞ্জে ছড়ানোর ব্যবস্থাও সে নিজেই করেছে। ভাইয়া নিজেও গোসল। করার সময় গানটা গায়। তার গলা খারাপ না, শুনতে ভালোই লাগে–
শুনেন শুনেন দশজনাতে শুনেন দিয়া মন
উন্নত পায়খানার কথা করিব বর্ণন।
আহা পায়খানারে। আহা পায়খানা রে।।
দশফুট গর্ত হবে কোনো চিন্তা নাই
তার উপরে স্লাভ বসিবে বলে দিয়া যাই
স্লাভের উপর রিং বসিবে বলি পরিষ্কার
উন্নত পায়খানা হলে চিন্তা নাইকো আর
আহা পায়খানারে। আহা পায়খানারে।।
মাকে পাবনা মেন্টাল হসপিটালে নিতে এসেছেন মায়ের দুই ভাই। দুই। জনই বয়সে মার ছোট। কিন্তু কেমন বুড়োটে দেখাচ্ছে। একজনের চুল দাড়ি পেকে শাদা। তার বোধ হয় হাঁপানি রোগও আছে। আসার পর থেকে হাঁপাচ্ছেন। মার সঙ্গে দুজনই খুব স্বাভাবিক গলায় কথা বলছেন। যেন মার। কোনো অসুখবিসুখ নেই। তিনি সুস্থ মানুষ। আমি এই দুই মামাকে আগে কখনো দেখেছি বলে মনে করতে পারলাম না। কিন্তু তারা আমার সঙ্গেও এমন ভাবে কথা বললেন যেন প্রায়ই আমাদের দেখা সাক্ষাৎ হয়। দুই মামার একজনের নাম হারুন। তার চেহারা সুখি সুখি। তিনি মনে হয় কথা বলতেও পছন্দ করেন। সবার সঙ্গে আন্তরিক ভঙ্গিতে কথা বলছেন। তিনি পান খেতে খেতে মাকে বললেন–আপনার সুখের সংসার দেখে চক্ষু জুড়ায়ে গেছে বুবু। আপনার বড় ছেলের সঙ্গে এখনো দেখা হয় নাই। ছোটজনকে দেখে চক্ষু জুড়ায়ে গেছে। দুলাভাই এর কাছে শুনলাম বড়জন এনজিওতে চাকরি করে। শুকুর আলহামদুলিল্লাহ। আল্লাহ্ পাকের খাস রহমত ছাড়া এটা সম্ভব না।
মা মনে হয় মামার কথা কিছুই বুঝলেন না। লম্বা ঘোমটা টেনে ফিস ফিস করে বললেন—আপনাদের খাওয়া দাওয়া হয়েছে?
হারুন মামা উৎসাহের সঙ্গে বললেন, আমাদের খাওয়া দাওয়া নিয়ে মোটেই চিন্তা করবেন না বুবু। আসার পর থাইকা খাওয়া খাদ্যের উপর আছি। আপনার শরীরটা খারাপ হয়েছে শুনে অত্যন্ত চিন্তাযুক্ত। তবে ইনশাল্লা সুচিকিৎসা হবে। সুস্থ হওনের পর বুবু আপনাকে দেশের বাড়িতে কয়েক দিনের জন্যে নিয়া যাব। খুবই গরিবি হালতে আছি আপনার কষ্ট হবে। বাপের বাড়ির কষ্ট অবশ্য গায়ে লাগে না। দুলাভাই এর সঙ্গে এই বিষয়ে আলাপ হয়েছে। দুলাভাই মত দিয়েছেন। বাকি আল্লাহপাকের ইচ্ছা।
মা আবারো ফিস ফিস করে বললেন আপনাদের খাওয়াদাওয়া হয়েছে।