ট্রেন ব্রিজের উপর উঠে পড়েছে। কুসুম আপুর আর দেরি করা উচিৎ না। কেন দেরি করছে। ঝপাং খেলার নিয়ম হচ্ছে ট্রেনের ইঞ্জিনের দিকে কখনো না তাকানো। ইঞ্জিনের দিকে চোখ পড়লেই নাকি হাত পা শক্ত হয়ে যায়। কুসুম আপু তাকিয়ে আছে ইঞ্জিনের দিকেই।
এক সময় ইঞ্জিন কুসুম আপুকে আড়াল করে ফেলল, তারপর ব্রিজ পার হয়ে গেল। আমি মগরা নদীর দিকে তাকিয়ে আছি। কুসুম আপুকে দেখতে পাচ্ছি—সাঁতার কেটে তীরের দিকে আসার চেষ্টা করছে। নদীতে প্রবল স্রোত। তার যে বেশ কষ্ট হচ্ছে তা দেখে বোঝা যাচ্ছে।
বাবা চোখ বড়বড় করে তাকিয়ে আছেন
বাবা চোখ বড়বড় করে তাকিয়ে আছেন। যেন ভাইয়াকে চিনতে পারছেন না। তার চেহারা চেনা চেনা লাগছে। কোথায় দেখেছেন মনে করতে না পারায় একটু যেন বিব্রত।
ভাইয়াকে অবশ্যি খুবই চেনা লাগছে। মাথায় বারান্দা দেয়া টুপি পরায় ভালো দেখাচ্ছে। ছোলা মাথা ঢাকা পড়েছে। গায়ের খাকি পােশাকটাও খুব। মানিয়েছে। সবচে মানিয়েছে পায়ের লাল রঙের কাপড়ের জুতো। খাকি পােশাক পরার জন্যেই হয়তো ভাইয়া অতিরিক্ত গম্ভীর হয়ে আছে। কারো চোখের দিকে সরাসরি তাকাচ্ছে না। খাকি পােশাক পরা মানুষ কারোর চোখের দিকেই সরাসরি তাকায় না। দুই ভুরুর মাঝখানে তাকায়। এটা আমার কথা না, রহমান চাচার কথা। তিনি যৌবনে আনসার বাহিনীতে ঢুকেছিলেন। সেখানেই নাকি। তাকে শেখানো হয়েছে দুষ্ট লোকজনদের চোখে চোখে না তাকিয়ে দুই ভুরুর মাঝখানে তাকাতে৷
বাবা চাপা গলায় বললেন—ব্যাপার কী সং সেজেছিস কেন?
ভাইয়া বলল, সার্ভিস পেয়েছি।
বাবা বললেন, কোন বেকুব তোকে চাকরি দিল?
এনজিওর চাকরি।
চাকরিটা কী?
গ্রামের বিভিন্ন বাড়িতে স্যানিটারি পায়খানা ফিটিং হবে। তার তদারকি। এ ছাড়াও আরো ডিউটি আছে।
বাবা ছোট্ট করে নিঃশ্বাস ফেললেন। হতাশ গলায় বললেন, শেষ পর্যন্ত্র পাইখানার মিস্ত্রি? আমার কোনো অসুবিধা নাই। অসুবিধা হবে তোর।
ভাইয়া গম্ভীর গলায় বলল, কী অসুবিধা?
তোর বিয়ে শাদি হবে না। পাত্রী পক্ষের কাছে খবর যাবে জামাই গু ইঞ্জিনিয়ার। গু ইঞ্জিনিয়ারকে বিয়ে করতে কোনো মেয়ে রাজি হবে না। মেয়েদের মধ্যে শুচিবায়ু বেশি থাকে।
আমার বিয়ে নিয়ে তোমাকে ভাবতে হবে না।
চাকরি যেমন যোগাড় করেছিস, বিয়েরও ব্যবস্থা হয়েছে? আলহামদুলিল্লাহ। দুটা বড় খবর শুধু মুখে দিলি। মিষ্টি কিনে আন। বাতাসা কিনে আন। সবাইকে একটা করে বাতাসা দিবি আর এক ঢোক পানি। গু চাকরিতে এরচে বেশি কিছু খাওয়ানো ঠিক না। লোক হাসবে।
ভাইয়া বাবার সামনে থেকে চলে গেল।
বাবা নিজের মনে বিড় বিড় করতে লাগলেন—কত রকম কারিগরের কথা শুনেছি—ঘরের কারিগর, জিলাপির কারিগর, আজ শুনলাম গুয়ের কারিগরের কথা। সেই কারিগর আমার ঘরে বসে আছে। আহা কী আনন্দ। কেউ যদি জিজ্ঞেস করে আপনার বড় ছেলে কী করে? আমি বুক ফুলিয়ে বলতে পারব, সে গু-কারিগর। তার সব বাণিজ্য গু নিয়ে।
বাবা আজকাল খুব বেশি কথা বলছেন। একবার কথা বলতে শুরু করলে আর থামেন না। কথা বলেই যান। বলেই যান। একই কথা নানান ভঙ্গিতে বলেন। শেষের দিকে শুনতে খুবই বিরক্তি লাগে। কেরোসিন চিকিৎসার সঙ্গে এর মনে হয় কোনো যোগ আছে। পেটের ব্যথার জন্যে কেরোসিন খাওয়া শুরুর পর থেকেই বাবার কথা বলা বেড়েছে।
আমি হাতের লেখা লিখছিলাম। বাবা আমার দিকে তাকিয়ে-তাকিয়ে ধমকের ভঙ্গিতে বললেন, চট করে একটা অংক কর। একটা গ্রামে তিনশ লোকের বাস। এরা প্রত্যেকে যদি গড়ে দৈনিক ৫০০ গ্রাম করে পায়খানা করে তাহলে এক মাসে গ্রামে গু এর পরিমাণ কত হবে? ঐকিক নিয়মে কর।
আমি বললাম, এই অংক করতে হবে কেন?
তোর ভাইতো আর অংক করতে পারবে না। গু-এর অংক সব তোর করতে হবে।
এই অংক আমি করব না।
আচ্ছা যা করিস না।
আমি বাবার সামনে থেকে উঠে চলে এলাম। বাবা নিজের মনে বিড়বিড় করতে লাগলেন। বিড়বিড় করে কী বলছেন বারান্দা থেকে শুনতে পাচ্ছি না। নিশ্চয়ই গু বিষয়ক কিছুই হবে।
বাবার কি শরীরের তাল নষ্ট হয়ে গেছে? একটা বয়সের পর মানুষের শরীরের তাল নষ্ট হয়ে যায়। সেই বয়সটা একেক জনের জন্যে একেক রকম। এটা আমার কথা না। জাপানি ইঞ্জিনিয়ার সাহেবের কথা। জ্ঞানী-জ্ঞানী কথা তিনি আগে বলতেন না। আজকাল বলেন। তিনি এখন ঘরের মানুষ হয়ে গেছেন। ঘরের মানুষ অনেক কিছু বলতে পারে। জ্ঞানের কথা তো বলতেই পারেই। তিনি যে শুধু জ্ঞানের কথা বলেন তা না, প্রাইভেট টিচারের মতো আমার পড়া ধরেন। আবার ধাঁধা জিজ্ঞেস করেন। জটিল সব ইংরেজি ধাঁধা। ঠোঁট গোল করে বলেন—বল দেখি টগর—নয় কেন সাতকে ভয় পায়? চট করে বল why nine is afraid of seven. নয় তো সাতের চেয়ে বড় নয়ের তো সাতকে ভয় পাবার কথা না। দেখি তোমার বুদ্ধি কেমন চট করে বল।
এ ধরণের ধাঁধা তিনি তখনি জিজ্ঞেস করেন যখন কুসুম আপু আশেপাশে থেকে। জাপানি ইঞ্জিনিয়ারের লক্ষ্য আমি না, কুসুম আপু। কাজেই আমি ধাঁধা নিয়ে মোটেই মাথা ঘামাই না। জাপানি ইঞ্জিনিয়ার খুবই হতাশ হয়ে বলেন, এ কী পারছ না কেন? চেষ্টা করে দেখ। আচ্ছা কুসুম তুমি বল।
কুসুম আপু হাই তুলতে তুলতে বলল—নয় সাতকে ভয় পায় কারণ নয় খুব ভীতু প্রকৃতির। আপনার মতো।
আমি ভীতু?
অবশ্যই ভীতু ঐ দিন ব্রিজের উপর দাঁড়িয়ে আপনাকে ডাকলাম। বললাম, আমাকে হাত ধরে নিয়ে যান। আপনি এসেছিলেন?