বাবা বারান্দায় মোড়ায় বসে পান খাচ্ছেন আর মা আঙুলে চুন নিয়ে পাশে দাঁড়িয়ে আছেন, দেখতে বড় ভালো লাগে।
আচ্ছা এখন আমাদের পরিচয়টা দিয়ে নিই। আমার বাবার নাম আজহার উদ্দিন। তিনি নান্দাইল রোড স্টেশনের স্টেশন মাস্টার। বয়স পঞ্চাশের ওপর। গায়ের রঙ কুচকুচে কালো বলে, দাঁতগুলি ধবধবে শাদা দেখায়। মনে হয় দাঁতে লাইট ফিট করা। অন্ধকারে জ্বলে। বাবা যেমন রোগা তেমন লম্বা। বাবার বন্ধুরা তাঁকে আজহার উদ্দিন ডাকে না, ডাকে তালগাছ উদ্দিন। এতে বাবা খুবই মজা পান। কেউ তাঁকে তালগাছ উদ্দিন ডাকলে সঙ্গে সঙ্গে তিনি পায়ের বুড়ো আঙুলে ভর করে আরেকটু লম্বা হন। জোকারি করতে বাবার খুব ভালো লাগে।
আমার মার নাম সুরমা। সিলেটের এক নদীর নামে তাঁর নাম। বাবা মাঝে মাঝে আদর করে তাঁকে কুশিয়ারা ডাকেন। কুশিয়ারাও সিলেটের আরেক নদী। কুশিয়ারা নদীটা ছোট হলেও সুরমার চেয়েও নাকি সুন্দর, টলটলা পানি। নদীর তলার বালি পাথর সব দেখা যায়। মা বয়সে বাবার চেয়ে অনেক ছোট। তাঁর বয়স খুব সম্ভব পঁয়ত্রিশের মতো। সব সময় তিনি কোনো-না-কোনো অসুখে ভুগেন। যখন তাঁর কোনো অসুখবিসুখ থাকে না তখন তাঁর আধাকপালী মাথা ব্যথা হয়। এই সময় ঘরের দরজা জানালা বন্ধ করে দিয়ে তাঁকে শুয়ে থাকা লাগে। কোনো রকম শব্দ করাও তখন নিষিদ্ধ। কেউ তখন শব্দ করে নিঃশ্বাসও ফেলতে পারবে না, এমন অবস্থা।
মার আধকপালী অসুখে বোধ হয় কোনো সমস্যা আছে। কারণ এই। অসুখটা যখন হয় তাঁর চেহারা তখন অন্য রকম হয়ে যায়। কী রকম অদ্ভুত করে তিনি সবার দিকে তাকান। মাঝে মাঝে এমনও হয় তিনি কাউকে চিনতে পারেন না। একদিন মার এ রকম মাথাব্যথা শুরু হয়েছে। আমি না জেনে তাঁর ঘরে ঢুকে পড়েছি। অবাক হয়ে দেখি গরমের মধ্যে তিনি কাঁথা গায়ে দিয়ে বসে আছেন। বড় বড় করে নিঃশ্বাস নিচ্ছেন। আমার দিকে তাকিয়ে বললেন–এই ছেলে এই, তোমার নাম কী? এইখানে কী চাও? যাও বাসায় যাও। দুপুর বেলা কেউ অন্যের বাড়িতে বসে থাকে, তোমার লজ্জা নাই?
আমি মার কথা শুনে অবাক হয়ে বললাম, মা আমাকে চিনতে পারছ না। আমি টগর।
মা আমার দিকে তাকালেন। তাঁর তাকানো দেখেই বুঝলাম তিনি আমাকে মোটেও চিনতে পারেন নি। মা বললেন, টগর তোর নাম? আমার সঙ্গে ফাজলামি? আমি তোর মুরুব্বি না? এই বলেই তিনি চক্ষের নিমিষে বালিশের নিচে রাখা সুপারি কাটার ছরতা আমার দিকে ছুঁড়ে দিলেন। ছরতা লেগে আমার মাথা কেটে গেল। এরপর আর কখনো আধকপালী মাথা ব্যথা উঠার সময় আমি মার ঘরে ঢুকি না।
আমার স্কুলের বন্ধুদের অনেকের ধারণা মার মাথা খারাপ। তাঁকে ঘরে তালাবন্ধ করে রাখা হয়। এটা ঠিক না। মাকে কখনো তালাবন্ধ করে রাখা হয় না। মার যখন মাথা ব্যথা থাকে না তখন তিনি সবার সাথে মজা করেন। সবচে বেশি মজা করেন রঞ্জু ভাইয়ার সঙ্গে। মা রঞ্জু ভাইয়াকে যতটা পছন্দ করেন রঞ্জু ভাইয়া মাকে তারচে তিনগুন বেশি পছন্দ করে। মার মাথা ব্যথা অসুখ হলে–রঞ্জু ভাইয়া স্কুলে যাবে না। মার ঘরের বন্ধ দরজার আশেপাশে। ঘুর ঘুর করবে। ঘরের ভেতর থেকে খুট করে কোনো শব্দ হলেই রঞ্জু ভাইয়া বলবে–মা তোমার কিছু লাগবে? বাইরে থেকে কথা বললেও রঞ্জু ভাইয়াও অসুখের সময় মার ঘরে ঢুকবে না। আমার মতো সেও মার ঘরে ঢুকতে ভয় পায়।
মার অসুখবিসুখ এবং আধকপালী রোগে ঘরের কাজ কর্মের কোনো অসুবিধা হয় না। বাবার দূর সম্পর্কের এক বোন (রহিমা ফুপু) সব কাজ করেন। এই মহিলা আশ্চর্য ধরণের মহিলা। খুবই রূপবতী। তাঁকে দেখলে মনে। হয় তিনি সব সময় সেজেগুজে আছেন। চুল সুন্দর করে আঁচড়ানো, শাড়িটা সুন্দর করে পরা। তাঁকে কখনো কাজ করতে দেখা যায় না, অথচ ঘরের প্রতিটি কাজ তিনি করেন। তাঁর একটা মাত্র মেয়ে কুসুম। মেয়েকে নিয়ে তিনি আমাদের সংসারে থাকেন কারণ তাঁর স্বামী তাঁকে ছেড়ে চলে গিয়েছেন। রহিমা খালার মেয়েটা তাঁর মার মতোই সুন্দর। তবে চেহারা কেমন যেন ভোঁতা ভোঁতা। তার পরেও কুসুম আপুকে দেখতে খুবই ভালো লাগে। আমার সব সময় ইচ্ছা করে তার আশেপাশে থাকতে। কুসুম আপু খুবই অহংকারী। সহজ ভাবে সে তাকাতেই পারে না। সব সময় বিরক্ত চোখে তাকায়। আমি কোনো কারণে তার কাছে গেলে সে ভুরু কুচকে বলবে, এই টগর! তুই সব সময় মেয়েদের আশেপাশে ঘুরঘুর করিস কেন? মেয়েদের গায়ের গন্ধ নাকে না গেলে ভাল লাগে না? এখনই এই অবস্থা? ফাজিল কোথাকার। গন্ধ নেবার সময় হোক, তখন গন্ধ নিবি। যা সামনে থেকে।
কুসুম আপু ক্লাস টেনে পড়ে। আগামী বছর সে এস. এস. সি. দেবে। তবে রঞ্জু ভাইয়ের মতো ফেল করবে না। এক চান্সেই পাশ করবে। কুসুম আপু ছাত্রী খুবই ভালো। ক্লাস ফাইভে বৃত্তি পেয়েছে। ক্লাস এইটেও বৃত্তি পেয়েছে।
আমরা থাকি রেল কোয়ার্টারে। ইস্টিশন ঘরের কাছেই লাল ইটের পাকা দালান। কোয়ার্টারটা দেওয়াল দিয়ে ঘেরা ছিল। জায়গায় জায়গায় সেই দেওয়াল ভেঙ্গে গেছে এবং সেই সব ভাঙ্গা জায়গায় আপনা আপনি লেবু গাছ গজিয়েছে। প্রকান্ড সব গাছ। খুব ফুল ফোটে, কখনো লেবু হয় না। গাছের মধ্যেও নারী পুরুষ আছে। আমাদের লেবু গাছ গুলোর মধ্যে একটা ছাড়া সবই নাকি পুরুষ। যে নারী গাছটা আছে সেটাতেও লেবু হচ্ছে না। বাবার ধারণা, পুরুষ গাছের সঙ্গে থেকে-থেকে মেয়ে গাছটার মধ্যেও পুরুষালী ভাব চলে আসছে। আমাদের। রেল কোয়ার্টারে প্রতি বর্ষায় ঘরে সাপ ঢোকে। বাস্তু সাপ বলেই কখনো মারা হয় না। তবে বাবা চিন্তিত হয়ে কার্বলিক এসিড কিনে এনে ঘরে ছড়িয়ে দেন। বাবার আবার খুবই সাপের ভয়। রেল কোয়ার্টারে তিনটা মোটে ঘর। একটাতে থাকেন মা-বাবা। একটায় রহিমা ফুপু আর কুসুম আপু। আর একটা হল বৈঠক খানা। সেখানে বড় চৌকি পাতা আছে। এই চৌকিতে থাকি আমরা দুই ভাই। রেল কোয়ার্টারের ভেতরের বারান্দার একটা অংশ বাঁশের দরমা দিয়ে ঢেকে ঘরের মতো করা হয়েছে। প্রায়ই বাবাকে সেখানে থাকতে হয়। কারণ মার আধাকপালী মাথাব্যথা উঠলে তিনি কাউকে সহ্য করতে পারেন না। তখন তিনি একা থাকেন। আমার ধারণা তখন বাবাও মাকে আমাদের মতো ভয় পান।