আমি বললাম, মদ খেতে খেতে এসেছে কে বলল?
রহমান চাচা গলা আরো নামিয়ে বললেন, চেহারা দেইখ্যা বোঝা যায়। কালা মানুষ, লাল টুকটুক ভাব ধরেছে দেখ না। আর সেলুন কারে কেউ আইব কিন্তু মদ খাইব না এই জিনিস আমি আমার জন্মে দেখি নাই। রেলে কাম করতেছি কম দিন হয় নাই। সেলুন কারের অনেক হিস্টোরি জানি। একবারের। ঘটনা শোন—ছিঃ ছিঃ খুবই শরমের হিস্টোরি। থাউক আইজ না। আরেকটু শেয়ানা হও তখন বলব।
রহমান চাচাকে আজ অদ্ভুত দেখাচ্ছে। বড় সাহেব আসা উপলক্ষে চুল কাটিয়েছেন। ইস্ত্রী করা খাকি সার্ট প্যান্ট পরেছেন। নতুন এক জোড়া কাপড়ের জুতো কেনা হয়েছে। অন্য সময় কুঁজো হয়ে দাঁড়িয়ে থাকতেন। আজ পাকা। বেতের লাঠির মতো সোজা। বাবার ক্ষেত্রে ঘটেছে উল্টো ঘটনা। বাবা খানিকটা কুঁজো হয়ে গেছেন। বাঁ হাত সারাক্ষণ পেটের উপর দিয়ে রেখেছেন বলে তাঁকে খুবই অদ্ভুত দেখাচ্ছে। তিনি বাঁ হাত পেটের উপর দিয়ে রেখেছেন কেন তার কারণটা তখনো জানি না। তাঁর বিনয় প্রকাশের একটা অংশ হতে পারে। কিংবা কোটের একটা বোতাম হয়তো খুলে পড়ে গেছে। পেট ব্যথা করছে। নাতো। কিছু দিন হল হঠাৎ-হঠাৎ বাবার প্রচন্ড পেট ব্যথা হচ্ছে। কে যেন বলেছে চায়ের চামচে দু চামচ কোরামিন খেলে পেট ব্যথা কমে। বাবা নিজে নিজে সেই চিকিৎসাও করছেন। আজকের ঘটনা কী? বড় সাহেব চলে যাবার পর বাবাকে জিজ্ঞেস করে জানতে হবে।
বড় সাহেবের বিকেলে যাবার কথা। তিনি দুপুর বারোটা পঁচিশ মিনিটে চলে গেলেন। মগরা ব্রিজের কাছে কিছুক্ষণ দাঁড়ালেন। জাপানি ইঞ্জিনিয়ারের সঙ্গে কিছুক্ষণ কথা বললেন। তারপর ক্রেনের ড্রাইভার জামশেদকে কানে ধরে কুড়িবার উঠবোস করবার হুকুম দিলেন।
এই অংশটায় সবাই মজা পেল। সবচে মজা পেলেন বড় সাহেব নিজে। অনেক্ষণ পর তার মুখে হাসি দেখা গেল।
আঠারোবাড়ি স্টেশনের স্টেশন মাস্টার সাহেব বড় সাহেবের জন্যে কুড়িটা কই মাছ পাঠিয়েছিলেন। এই সময়ে এত বড় কই মাছ পাওয়ার কোনোই কারণ নেই। তিনি কীভাবে যোগাড় করলেন কে জানে। বড় সাহেব যেহেতু চলে গেছেন কুড়িটা কই মাছ আমাদের বাসায় চলে গেছে। আমাকে পাঠানো হল। জাপানি ইঞ্জিনিয়ার সাহেবকে দাওয়াত দিয়ে নিয়ে আসতে। দুপুরে যেন। আমাদের সঙ্গে কই মাছের ঝোল খান। কুসুম আপু বলল, এই আমিও তোর সঙ্গে যাব। একটা ছাতি যোগাড় কর। রোদের মধ্যে হাঁটতে পারবো না। তুই আমার মাথার উপর ছাতি ধরে থাকবি।।
তোমার যাবার দরকার কী?
উনার সঙ্গে আমার গোপন কিছু কথা আছে।
কুসুম আপুকে সঙ্গে নিয়ে যাচ্ছি। বৃষ্টি হচ্ছে না। আকাশ মেঘলা। তারপরেও আমি কুসুম আপুর মাথার উপর ছাতি ধরে আছি। পথ কাদা হয়ে আছে। আমি বললাম, রেল লাইনের স্লীপারের উপর পা দিয়ে দিয়ে হাঁটবে?
কুসুম আপু বলল, না। লম্বা-লম্বা পা ফেলা মেয়েদের জন্যে নিষেধ।
কেন?
মেয়েদের অনেক ব্যাপার আছে। তুমি বুঝবি না। বাঁ দিকে তাকিয়ে দেখতো মাথা ছোলা ফেলকুমার বসে আছে কিনা।
আমি বললাম, হুঁ।
ফেলকুমার কি সিগারেট টানছে?
হুঁ।
খবরদার ওদিকে তাকাবি না। তাকালেই ডাকবে।
না তাকালেও ডাকবে।
ডাকুক খবরদার জবাব দিবি না। গট গট করে আমার পেছন পেছন হাঁটতে থাকবি।
আচ্ছা।
ভাইয়ার দিকে আমি তাকাচ্ছি না, কিন্তু বুঝতে পারছি ভাইয়া অবাক হয়ে আমাদের দেখছে। এতই অবাক হয়েছে যে সিগারেট টানতে ভুলে গেছে। সিগারেট গেছে নিবে। রহমান চাচার কথা অনুসারে বাইস্যা মাসে সিগারেট হয়ে যায় বিড়ির মতো। একটা টান সামান্য দেরি করে দিলেই সিগারেট যায় নিবে। আমাদের দেখার পর ভাইয়া নিশ্চয়ই সময়মতো সিগারেট টান দেবে না। দেরি হবেই।
টগর তোরা কই যাচ্ছিস?
আমি না শোনার ভান করলাম।
এই টগর এই।
আমি কুসুম আপুর অন্য পাশে চলে এলাম। ভাইয়া সাইকেলের ঘন্টা বাজাচ্ছে। কুসুম আপু বলল, খবরদার পেছনে তাকাবি না। পেছনে তাকালে খেজুর কাঁটা দিয়ে চোখ গেলে দেব।
ভাইয়া সাইকেল নিয়ে চলে আসছে।
আসুক আসলে দেখা যাবে। কথা যা বলার আমি বলব। তুই চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকবি।
ভাইয়া ঝড়ের গতিতে সাইকেল নিয়ে উপস্থিত হল। তার মুখ রাগে থমথম করছে। তাকে ভয়ংকর দেখাচ্ছে। ভাইয়া কুসুম আপুর দিকে তাকিয়ে বলল, কুসুম যাচ্ছ কোথায়?
কুসুম আপু অবহেলার ভঙ্গিতে বলল, মগরা ব্রিজে।
ঐখানে কী?
ঝপাং খেলা খেলব। দুটার সময় চিটাগাং মেইল আসবে। তখন ঝাঁপ দিব।
পাগল নাকি?
পাগল হব কী জন্যে। তুমি ঝপাং খেলা খেলতে পার আমি পারি না। আমিও পারি।
এইসব মেয়েদের খেলা না।
ছেলেরা যেসব খেলা খেলতে পারে। মেয়েরাও পারে। তবে কিছু কিছু খেলা শুধু মেয়েরা খেলতে পারে। ছেলেরা পারে না।
কুসুম বাসায় চল।
না।
না মানে? তোকে চুল ধরে টেনে নিয়ে যাব। এই টগর আমার সাইকেলটা ধরতো।
কুসুম আপু হতাশ ভঙ্গিতে বলল, ঝপাং খেলা খেলতে যাচ্ছি না। ইঞ্জিনিয়ার সাহেব আমাকে আর টগরকে কফি খাবার নিমন্ত্রণ করেছেন। কফি খেতে যাচ্ছি।
কফি খাবার দাওয়াত করল কেন?
সুন্দর মেয়ে দেখলে ছেলেদের মাথা ঠিক থাকে না। সুন্দরী মেয়েদের গায়ের বাতাস খাবার জন্যে ছেলেরা করে না এমন জিনিস নাই। তুমি পেছনেপেছনে আসছ কেন? তোমাকে তো আর কফি খেতে বলে নি।
ভাইয়া সাইকেল হাতে দাঁড়িয়ে পড়ল। আমরা এগিয়ে গেলাম।
জাপানি ইঞ্জিনিয়ার আমাদের দেখে কী করবেন তাই যেন বুঝতে পারছেন। না। প্রতিটা কথা দুবার তিনবার করে বলছেন। অকারণে হাসছেন। দেখার মতো দৃশ্য।