আমি ঘুমুতে গেলাম না। ভাইয়ার সঙ্গে কল ঘরে গেলাম। ভাইয়া অজু করতে করতে বলল, ফজর ওয়াক্তে ঘুম থেকে উঠে নামায পড়ে কেউ যদি বাইরে হাঁটাহাঁটি করে তাতেও সোয়াব আছে। এই সময় আল্লাহ্ পাক বেহেস্তের। সব দরজা খুলে দেন। বেহেশতি হাওয়া শরীরে লাগে। একবার যাদের শরীরে বেহেশতি হাওয়া লাগে তাদের দোজখ নসিব হয় না।
ভাইয়া অজু করছে। আমি তার পাশে বসে শরীরে বেহেশতি হাওয়া লাগাচ্ছি। হাওয়াটা খুবই আরামদায়ক—ঠাণ্ডা-ঠাণ্ডা হাওয়া। শরীর সামান্য শিরশির করে।
আমি হঠাৎ করে বললাম, ভাইয়া কুসুম আপুর কোথায় বিয়ে এটা কি। আল্লাহ্ নির্ধারণ করে রেখেছেন?
ভাইয়া বললেন, অবশ্যই। এই বিষয়ে মানুষের কোনোই হাত নেই। তুই তার চেয়ে বয়সে কত ছোট কিন্তু আল্লাহ্ পাকের আদেশ থাকলে তোর সঙ্গেও বিবাহ হতে পারে। রহিম বাদশা আর রূপবানের বিবাহ হয়েছিল না। রূপবান ছিল পূর্ণ যুবতী আর রহিম বাদশা দুধের শিশু। রূপবান রহিম বাদশাকে কোলে। নিয়ে বেড়াত।
আমি বললাম, আবার জাপানি ইঞ্জিনিয়ারের সাথেও কুসুম আপুর বিয়ে হতে পারে তাই না? ভাইয়া হতভম্ব হয়ে বলল, জাপানি ইঞ্জিনিয়ার কে? আমি জবাব দিলাম না। অনেকক্ষণ থেকেই ভাইয়াকে চমকে দিতে ইচ্ছা করছিল। এখন চমকে দিলাম। ভাইয়া গম্ভীর গলায় আবার বলল, জাপানি ইঞ্জিনিয়ারটা কে?
রেলের খুব বড় অফিসার
রেলের খুব বড় অফিসার আসবেন। মেম্বার নাকি কী যেন বলে। মগরা ব্রিজ নিয়ে কী এক তদন্ত নাকি শুরু হয়েছে। বড় অফিসার সরজমিনে দেখবেন। জিজ্ঞাসাবাদ করবেন। সকালে এসে সারাদিন থাকবেন, বিকেলে চলে যাবেন। দুপুরে খাওয়া দাওয়া করবেন। তবে খাওয়া দাওয়া নিয়ে ব্যতিব্যস্ত হবার কিছু নেই। তিনি সেলুনে করে আসবেন। সেই সেলুনে খাবার ঘর আছে। বাবুর্চি আছে। রান্নাবান্না বাবুর্চি করবে।
সেলুন আমি আগে কখনো দেখি নি। সেলুন দেখতে পাব সেই উত্তেজনায় আমার অস্থির লাগতে লাগল। যে সাজ-সাজ রব পড়েছে সেটা দেখতেও ভালো লাগছে। রহমান চাচার প্রধান কাজ হয়েছে-ইস্টিশনের চারিদিকের জংলা পরিষ্কার করা। রহমান চাচা লম্বা এক ধারাল বাঁকা দা নিয়ে জংলা সাফ করেন আর বিড় বিড় করে বলেন—লাভ নাই। লাভ লোকসান কিছুই নাই। আমি কাছে গেলে সরু চোখে বলেন, কাছে আসবা না দায়ের কাম করতাছি কাছে আসবা না। যারা দা কুড়ালের কাম করে তারার মাথা ঠিক থাকে না। এই দেখবা গাছ কাটতাছে এই দেখবা মাইনষের মাথা বরাবর কোপ।
রহমান চাচার কথাবার্তার এখন আর কোনোই ঠিক ঠিকানা নেই। মাথা মনে হয় পুরোপুরিই গেছে। বাবা বলে দিয়েছেন—রেলের সাহেব আসার আগে। আগে রহমানকে দূরে কোথাও পাঠায়ে দিতে হবে। কখন কী বলে ফেলে তার নাই ঠিক।।
বড় সাহেবের আগমন উপলক্ষে আমাদের বাড়ি ঘরও ঠিক ঠাক করা হচ্ছে। বাড়ির সামনের জংলা সাফ করানো হচ্ছে। বড় সাহেবদের মেজাজ মর্জি তো আগে ভাগে বোঝা যায় না। হঠাৎ হয়তো বলে বসলেন—ইস্টিশন মাস্টার সাহেব, চলুন দেখি আপনার কোয়ার্টার দেখে আসি। বাবা যখন বারহাট্টা স্টেশনের স্টেশন মাস্টার তখন একবার রেলের খুব বড় অফিসার এসেছিলেন। কথা বার্তা নেই হঠাৎ তিনি বললেন, স্টেশন মাস্টার সাহেব চলুন তো আপনি কোথায় থাকেন দেখে আসি। আর এক কাপ চাও খেয়ে আসি। আপনার। বাড়িতে চায়ের ব্যবস্থা আছে না?
বাবা হাত কচলাতে কচলাতে বললেন, জি স্যার আছে।
সেই সময় আমাদের বাসায় চা খাবার চল ছিল না। চায়ের কাপ পিরিচ কিছুই নেই।
মানুষের জীবনে যেমন স্মরণীয় ঘটনা থাকে। বাবার জীবনে স্মরণীয় ঘটনা বুঝি এই একটাই। তিনি কতবার যে কতজনকে এই গল্প বলেছেন—বুঝলেন ভাই সাহেব। মানুষ সাত হাত পানির নিচে যায়। আমি চলে গেলাম পঁচিশ হাত পানির নিচে। বড় সাহেবকে বলেছি চায়ের ব্যবস্থা আছে। উনি বাসায় চলে এসেছেন, সঙ্গে উনার পি. এ. চায়ের জন্যে অপেক্ষা করছেন। আমার ঘরে না আছে চা-চিনি-দুধ, না আছে চায়ের কাপ। আমি এক মনে দোয়া ইউনুস পড়তেছি আর আল্লাহ্ পাককে বলতেছি— আল্লাহ্ পাক আমাকে উদ্ধার কর। শেষে আল্লাহ্ পাক উদ্ধার করলেন। সেই দিন প্রথম বুঝলাম, এক দিলে আল্লাহর কাছে কিছু চাইলে আল্লাহ্ বান্দাকে সেই জিনিস দেন। এই দেখেন। ঘটনা বলতে গিয়ে গায়ের লোম খাড়া হয়ে গেছে। দেখেন হাত দিয়ে দেখেন। … … …..
বৃহস্পতিবার সকাল দশটায় সেলুনে করে বড় সাহেব এলেন। সেলুনটা বাইরে থেকে তেমন কিছু না, রেলের কামরার মতো কামরা শুধু জানালায় পর্দা দেয়া। যে বড় সাহেব কামরা থেকে নামলেন, তাঁকে দেখে খুবই হতাশ হলাম। গাট্টাগোট্টা বেটে একজন মানুষ। মুখ ভর্তি পান। চক্রা বা একটা হাফ সার্ট পরেছেন, সেই সার্ট ফুড়ে তার ভুড়ি বের হয়ে আসছে। মানুষ যখন হাটে তখনি শুধু তার ভুড়ি কাঁপে। এই ভদ্র লোকের ভুড়ি সারাক্ষণই কাঁপে। আমি তার ভুড়ির দিকেই তাকিয়ে রইলাম।
খুব যারা বড় সাহেব তারা কখনো রাগী হন না। রাগ হলেও এরা রাগ চেপে মুখ হাসি-হাসি করে রাখে। ইনি সেলুন থেকে নেমেই রাগারাগি হই-চই করতে লাগলেন। কার উপর রাগ করছেন সেটাও পরিষ্কার না। একবার মনে। হচ্ছে তার সঙ্গে যারা এসেছেন তাদের উপর রাগ করছেন, আবার মনে হচ্ছে স্টেশনে তার সামনে যারা দাঁড়িয়ে আছেন তাদের উপর রাগ করছেন। কিছুই বোঝা যাচ্ছে না। আমি রহমান চাচার পাশে দাঁড়িয়ে ছিলাম। রহমান চাচা গলা নামিয়ে ফিস ফিস করে বললেন, মদ খাইতে-খাইতে আইছে তো। মদ মাথাত উইঠ্যা এই সমস্যা। এখন কী করে কিছুই ঠিক নাই। গাঞ্জার নিশা এই জন্যই সেরা নিশা। গাঁজা খাইয়া কেউ উল্টা পাল্টা কিছু করছে এইটা কোনোদিন শুনবা না।