কুসুম আপু বলল, ভালোই আছি। খারাপ থাকব কেন?
তোর চুল দেখি আগের মতোই আছে। কাটার পর লম্বা হয় নি।
লম্বা হবার সুযোগ পায় না। একটু লম্বা হলেই ঘ্যাচ করে আবার কেটে ফেলি।
চুল লম্বা না হলেও তুই নিজে লম্বা হয়েছিস। এক ইঞ্চি লম্বা অবিশ্যিই হয়েছিস।
কুসুম আপু হাই তুলতে তুলতে বলল, লম্বা হলে তো ভালোই।
ভাইয়া কুসুম আপুর খাটে বসতে বসতে বলল, দাড়ি রেখে ফেলেছি। দেখছিস। দাড়ি রাখার হিস্টরিটা শোন-মুরাদনগরে এক পীর সাহেবের বাড়িতে। ছিলাম। পীর সাহেবের দুই ছেলে। পীর সাহেবের মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে দুইজন পীরাতি দাবি করে বসেছে। দাফন হয় নাই তারমধ্যে একে অন্যকে লাঠি নিয়ে মারতে যায় এমন অবস্থা। বিরাট দলাদলি। মুরিদানরাও দুই ভাগে ভাগ হয়ে গেছে। বেশির ভাগ মুরিদান নি-দাড়ি পীরের পক্ষে। নি-দাড়ি বুঝলি তো? দাড়ি নাই। পীর সাহেবের দুই ছেলের একজন মাকুন্দা তার নাম নি-দাড়ি পীর।
অন্যজনের মুখ ভর্তি সিংহের মতো দাড়ি, সেই জন্যেই নাম দাড়ি পীর।
কুসুম আপু গল্প শুনে কোনো মজা পাচ্ছে বলে মনে হচ্ছে না। একটু পর পর হাই তুলছে। গল্পের মাঝখানে উঠে দাঁড়িয়ে বলল, যাই গোসল করব। বেশি ঘুমিয়েছি তো। শরীর আঠা-আঠা হয়ে আছে। এই আঠার নাম ঘুম-আঠা। ঘুম। আঠায় গা ঘিনঘিন করে।
খুব মজার কোনো গল্পের মাঝখানে উঠে চলে যাওয়া কুসুম আপুর খুবই পুরানো অভ্যাস। ভাইয়া কুসুম আপুর এই অভ্যাসের সঙ্গে খুবই পরিচিত, তারপরেও ভাইয়া বেশ মন খারাপ করল। আমি বললাম, তারপর কী হয়েছে বল।
ভাইয়া হতাশ গলায় বলল, আরেক দিন বলব। টায়ার্ড লাগছে। তোদের খবর কী বল?
খবর ভালো।
মার শরীর কি বেশি খারাপ নাকি!
উঁহু বেশি খারাপ না।
সবাইকে চিনতে পারে?
হুঁ।
মার জন্যে মুরাদনগরের পীর সাহেবের তাবিজ নিয়ে এসেছি। আমাবস্যায় পরাতে হবে। পূর্ণিমাতে খুলে ফেলতে হবে।
কোন পীর তাবিজ দিয়েছে? নি-দাড়ি পীর?
উঁহু আসল জন। উনার জিন সাধনা আছে। জিনের মাধ্যমে আনায়ে দিয়েছেন। শেষের দিকে আমাকে অত্যাধিক পেয়ার করতেন।
উনার মৃত্যুর পর জিনগুলির কী হয়েছে?
পাঁচটা জিন ছিল। সম্পত্তি ভাগের মতো জিন ভাগ করেছেন। দুই ছেলেকে দুটা দুটা করে দিয়েছেন। আর একটাকে আজাদ করে দিয়েছেন। সবচে যেটা ভালো ছিল তাকেই আজাদ করেছেন। তার নাম কফিল।
তুমি জিন কফিলকে দেখেছ?
দেখি নাই। তবে কথাবার্তা শুনেছি। খুবই ফ্যাসফ্যাসে গলা। সর্দি-সর্দি ভাব। বাংলায় কথা বলে তারপরও সব কথা বোঝা যায় না।
মার তাবিজটা কে এনে দিয়েছে? কফিল?
জানি না। বড় হুজুর শুধু বলেছেন, জিনের মাধ্যমে আনায়েছেন। এর বেশি কিছু বলেন নাই। বড় হুজুর কথাবার্তা খুবই কম বলতেন। তাঁর কথাবার্তা সবই ইশারায়। এক আঙুল তোলা মানে পানি খাবেন। দুই আঙুল তোলার অর্থ পান খাবেন। তিন আঙুল তুললে-তামাক। চার আঙুলে চা, পাঁচ আঙুলে খানা খাবেন। দুই হাতের দশ আঙুল তুললে বুঝতে হবে আজ দিনের মতো কাজকর্ম শেষ। তিনি মরতবায় বসবেন।
মরতবা কি?
ঘরের দরজা জানালা বন্ধ করে সাধনা। জিন সাধনা কঠিন জিনিস। চল যাই মাকে দেখে আসি।
তুমি যাও। আমি যাব না।
তুই যাবি না কেন?
চিনতেটিনতে পারে না। খারাপ লাগে।
মা সন্তানকে চিনতে পারে না, এটা একটা কথা হল। চিনতে ঠিকই পারে। মুখে বলে না।
ভাইয়া আমাকে সঙ্গে নিয়ে মার ঘরে ঢুকলেন। দরজা জানালা সব বন্ধ বলে ঘর অন্ধকার। ঘরে কেমন ধোঁয়া ধোঁয়া গন্ধ। মনে হচ্ছে ভেজা খড় পুড়িয়ে ধোঁয়া দেওয়া হয়েছে। ধোঁয়া নেই—গন্ধটা আছে। মা শুয়ে ছিলেন, তিনি ধড়মড় করে উঠে বসতে-বসতে বললেন, কে?
ভাইয়া বলল, মা আমি রঞ্জু।
মা ক্ষীণ গলায় বললেন, টগরের বাবা ইস্টিশনে গেছেন। আপনে ইস্টিশনে যান।
ভাইয়া বললেন, মা চিনতে পারছ না। আমি রঞ্জু।
মা মাথার ঘোমটা দিতে দিতে বললেন, জি আমি চিনতে পেরেছি। আপনে বারান্দায় বসেন। আপনেরে চা দিব।
ভাইয়া ঘর থেকে বের হলেন। নিচু গলায় বললেন, পীর সাহেবের তাবিজটা দিলেই দেখবি সব ঠিক হয়ে গেছে। শুধু আমাবস্যা কবে এটা খুঁজে বের করতে হবে। লোকনাথ ডাইরেক্টরি পঞ্জিকা লাগবে। আর লাগবে একটা নতুন শাড়ি। নতুন শাড়ি পরায়ে তাবিজটা চুলের গোড়ায় বাঁধতে হবে। যন্ত্রণা আছে।
ভাইয়া দাড়ি গোঁফ কামাতে নাপিতের কাছে গেলেন। আমিও সাথে গেলাম। অনেক গল্প জমা আছে—এক এক করে সব গল্প শেষ করতে হবে। ভাইয়াকে দেখে আমার খুবই ভাল লাগছে। এত ভালো লাগবে কোনোদিন ভাবি নি।
ভাইয়া শুধু যে দাড়ি গোঁফ কামাল তা না। মাথাও কামিয়ে ফেলল। মাথা ভর্তি নাকি খুশকি। খুশকির একটাই চিকিৎসা মাথা কামিয়ে ফেলা। মাথা কামানোর সঙ্গে সঙ্গে ভাইয়ার শরীর থেকে লোক লোক ব্যাপারটা চলে গেল। তাকে এখন আর অচেনা লাগছে না। শুধু মনে হচ্ছে অনেক দিন খারাপ। ধরণের জ্বরে ভুগেছিল। জ্বর সেরে শিং মাছের ঝোল দিয়ে পথ্য করছে।
মাথা কামিয়ে ভাইয়া আমাকে নিয়ে চা খেতে গেল। আগে চাই খেতে পারত না এখন তার নাকি রেস্টুরেন্টে চা খাওয়া অভ্যাস হয়ে গেছে। ঘরের চা। খেতে পারে না। চায়ের অর্ডার দিয়ে গম্ভীর মুখে বলল,
তোর পড়াশোনার খবর কী রে?
খবর ভালো।
স্মৃতি শক্তি বাড়ানোর একটা দোয়াও শিখে এসেছি। পড়তে বাসার আগে তিনবার বলতে হয়—দোয়াটা কাগজে লিখে এনেছি। এখন থেকে এই দোয়া আমল করবি।
আচ্ছা।
আমি আর পড়াশোনা করব না সিদ্ধান্ত নিয়েছি। পড়াশোনা করলে আমিও এই দোয়া আমল করতাম।