আমি বললাম, জি।
উনি বললেন, আমার তো একটা প্রবলেম আছে। আমি কারো সঙ্গে বিছানা শেয়ার করতে পারি না। ভালো ঝামেলায় পড়লাম দেখি। আচ্ছা তুমি ঘুমাও—আমি রাতটা বারান্দার চেয়ারে বসে পার করে দেব।
আর তখনি মা খুব হইচই কান্নাকাটি শুরু করলেন। ইঞ্জিনিয়ার সাহেব চমকে উঠে বললেন, ব্যাপার কী কাঁদে কে?
আমি বললাম মা কাঁদছে। উনার মাথার যন্ত্রণা হলে এ রকম করেন।
উনি ভীত গলায় বললেন, আমার কাছে তো পাগলের প্রলাপ বলে মনে হচ্ছে। জিনিস পত্রও তো ভাঙ্গাভাঙ্গি হচ্ছে তোমার মার মাথা খারাপ নাকি?
আমি আহত গলায় বললাম, না।
উনি বললেন, এই বাড়িতে সিনিয়ার কেউ নেই? কুসুমের মা? উনাকে একটু ডাক আমি কথা বলি। মাই গড। আমার তো ধারণা আমি ভয়াবহ বিপদে পড়েছি। ডাক। কুসুমের মাকে ডাক৷
আমি বললাম, রহিমা ফুপু বাইরের কোনো পুরুষ মানুষের সঙ্গে কথা বলেন না।
ভালো যন্ত্রণায় পড়লাম তো। আচ্ছা ঠিক আছে তুমি ঘুমাও। আমি বারান্দায় আছি। তবে ঠিক নেই। আমি চলেও যেতে পারি।
উনি একা বারান্দায় বসে রইলেন। ঝুমঝুম বৃষ্টি শুরু হল। আমি বিছানায় শুয়ে জেগে থাকার চেষ্টা করতে করতে এক সময় ঘুমিয়ে পড়লাম। ঘুম ভাঙ্গল খুব ভোরে। বৃষ্টি থেমে গেছে। ঘর আবছা আলো হয়ে আছে। এ-রকম সময় ঘুম ভাঙ্গাটা খুব আনন্দের। চোখ বন্ধ করলেই সঙ্গে সঙ্গেই ঘুমিয়ে পড়া যায়। আমি ঘুমোতে পারলাম না। কারণ কুসুম আপুর গলা শোনা যাচ্ছে। আপু জাপানি ইঞ্জিনিয়ারের সঙ্গে কথা বলছে। মনে হচ্ছে আপু কথা বলে খুব মজা পাচ্ছে।
দুটা সাপ দেখেই আপনি ভয় পেয়ে পালিয়ে এলেন। আপনি হচ্ছেন সর্প খাদক। আপনার উচিৎ ছিল সাপ দুটি ধরে কেটে কুটে খেয়ে ফেলা। একটার ঝোল আর একটার দোপেয়াজা।
তুমি তো আশ্চর্য মেয়ে সাপ সাপ করেই যাচ্ছ। সাপ ছাড়া এই পৃথিবীতে কথা বলার আর বিষয় নেই।
আপনি কথা বলুন আমি শুনছি। দেখি কাছে আসতো তোমার জ্বরের অবস্থাটা দেখি।
আধঘন্টার মধ্যে চারবার জ্বর দেখলেন। এর চে একটা কাজ করলে কেমন হয় আপনি সারাক্ষণ একটা হাত আমার কপালে দিয়ে রাখেন। হি হি হি।
কুসুম আপু হেসেই যাচ্ছে। সেই হাসি থামছে না। আমি কুসুম আপুর হাসি। শুনতে-শুনতে আবার ঘুমিয়ে পড়লাম।
রঞ্জু ভাইয়া এক সন্ধ্যায় চলে গিয়েছিল
রঞ্জু ভাইয়া এক সন্ধ্যায় চলে গিয়েছিল, আর এক সন্ধ্যায় ফিরল। সন্ধ্যাবেলায় চেনা মানুষকেই অচেনা লাগে, তাঁকে আরো অচেনা লাগছে। কেমন লোক-লোক দেখাচ্ছে। নাকের নিচে গোঁফ। গাল ভর্তি দাড়ি। মাথার চুলও অনেক বড় হয়েছে। তার চেহারাই যে লোক-লোক হয়েছে তা না, গা দিয়ে কেমন লোক-লোক গন্ধও বের হচ্ছে।
আমি দেখলাম অচেনা একজন মানুষের সঙ্গে যে ভাবে কথা বলা হয় বাবা তার সঙ্গে ঠিক সে ভাবেই কথা বলছেন। বাবার গলায় কোনো রাগ নেই। কোনো কৌতূহলও নেই।
তারপর তুই ফিরলি কী মনে করে? আমি তো ভেবেছিলাম ফিরবি না। আছিস কেমন?
ভালো।
দাড়ি কি ইচ্ছা করে রেখেছিস নাকি কামানোর পয়সা নেই?
ভাইয়া জবাব দিল না। দাড়ি চুলকাতে লাগলেন।
বাবা বললেন, দাড়িতে উকুন হয়েছে নাকি? টাকা নিয়ে যা, ক্ষৌরি করে আয়। এই চেহারা নিয়ে তোর মার সামনে যাবি না। ভয় পাবে। কয়েকদিন ধরে তার শরীরটা খারাপ করেছে। আর তোর পরিকল্পনাটা কী? এই খানেই। থাকবি না ভূপর্যটনে বের হবি? ভূপর্যটক রমানাথ বিশ্বাস। সাইকেলে বিশ্ব ভ্রমন করেন।
ভাইয়া ঘাড় সোজা করে দাঁড়িয়ে রইল। বাবা স্টেশন মাস্টারের কোট গায়ে দিতে দিতে বললেন—তোর পড়াশোনা তো হবে না। চেষ্টা করেও লাভ নেই। একটা রিকশা কিনে দেই। সকাল সন্ধ্যা রিকশা টানবি। তোর শরীর তো ভালোই আছে। বাইরে-বাইরে ঘুরে আরো তাজা হয়ে এসেছিস। রোগা পটকা। গরু যেমন ভাটি অঞ্চলের তাজা ঘাস খেয়ে মোটা হয়ে ফিরে। তোকে অবিকল সে রকম লাগছে। রিকশাটানার কাজ ভালো পারবি। কিংবা ইস্টিশনে কুলির কাজও করতে পারিস। বাবা ব্যাটা একই জায়গায় কাজ করব। খারাপ কী?
বাবার কোনো কথাই কানে যাচ্ছে না এমন ভঙ্গিতে ভাইয়া কলতলায় হাতমুখ ধুতে গেল। আমি ছুটে গেলাম কল চাপতে। ভাইয়াকে এত বেশি অচেনা লাগছে যে আমার খারাপ লাগছে। কাছাকাছি থেকে যদি অচেনা ভাবটা দূর করা যায়।
রঞ্জু ভাইয়া চোখে মুখে পানি দিতে দিতে বলল, ফিরার কোনো ইচ্ছা ছিল। স্বপ্ন দেখে ফিরলাম। স্বপ্নটা না দেখলে ফিরতাম না।
কী স্বপ্ন?
শাদা রঙের একটা হাতির পিঠে মা বসে আছে, গা ভর্তি গয়না। এই স্বপ্নের অর্থ ভালো না। গয়না পরে পালকিতে ওঠা, হাতি-ঘোড়ায় চড়া দেখা খুবই খারাপ।
ও।
কুসুম আছে কেমন?
ভালো।
কুসুমকেও একদিন স্বপ্নে দেখলাম। মাথার চুল লম্বা হয়ে পায়ের গোড়ালী পর্যন্ত গেছে। মেয়েদের চুল লম্বা দেখাও খারাপ আবার খাটো দেখাও খারাপ। মেয়েদের মাথা পুরোপুরি কামানো দেখা ভয়ংকর খারাপ। গয়না পরে হাতির পিঠে চড়ার মতো খারাপ। এই ধরণের স্বপ্ন দেখলে সদকা দিতে হয়।
ভাইয়া কুসুম আপুর সঙ্গে কথা বলতে গেল। কুসুম আপু দরজা বন্ধ করে ঘুমুচ্ছিল। ইদানীং তার ঘুম খুব বেড়েছে। দুপুরে ঘুমুতে যায়—সন্ধ্যা পর্যন্ত ঘুমায়। তার সারারাত ঘুম হয় না বলে এই ঘুমটা নাকি খুব দরকার। কুসুম আপু দরজা খুলল, ভাইয়াকে দেখে একটুও চমকালো না। এমন ভাবে তাকাল। যেন ভাইয়া এই বাড়িতেই ছিল। কোথাও নিরুদ্দেশ হয়ে যায় নি।
ভাইয়া বলল, আছিস কেমন?