তিনি বের হলেন টিনের একটা কৌটা নিয়ে। হড়বড় করে বললেন, ম্যাগাজিন গুলি খুঁজে পাচ্ছি না। রাতে খুঁজে রাখব। খোকা তুমি কাল একবার এসে নিয়ে যেতে পারবে না?
আমি বললাম, পারব।
তিনি বললেন, না থাক তোমার আসতে হবে না। বাচ্চা মানুষ একা একা এত দূর আসবে। আমিই কাউকে দিয়ে পাঠাব। কিংবা নিজেও আসতে পারি। বিকেলে এসে এক কাপ চা খেয়ে গেলাম ম্যাগাজিনগুলিও দিয়ে গেলাম। আইডিয়াটা কেমন?
ভালো।
বেশ তাহলে তুমি যাও। ধর এই কৌটাটা নিয়ে যাও। রোস্টেড পিনাট। চীনা বাদাম। তোমার আপাকে দিও। আর এই চিঠিটাও দিও। ম্যাগাজিনগুলো। যে খুঁজে পাই নি সেটা লিখে দিয়েছি। বেচারিকে বলে এসেছিলাম ম্যাগাজিন পাঠাব। সে হয়তো আশা করে আছে। কোনো জিনিসের জন্য আশা করে। থাকলে সেই জিনিস না পাওয়া গেলে খুবই কষ্ট হয়। আর শোন আমি যে কাল। আসব এটাও বলার দরকার নেই। কারণ নাও আসতে পারি। কাজের চাপ খুব বেশি।
জি আচ্ছা।
অন্ধকার হয়ে গেছে একা একা যেতে পারবে তো?
পারবো।
দাঁড়াও তোমাকে একটা টর্চ লাইট দিয়ে দেই।
তিনি আবার তাঁবুর ভেতর ঢুকে গেলেন। টর্চ লাইট সম্ভবত খুঁজে পাচ্ছিলেন না। তাঁবু থেকে মুখ শুকনো করে বের হলেন হাতে সবুজ রঙের অদ্ভুত এক টর্চ।
খোকা শশান টর্চটা আমাকে ফেরৎ দিতে হবে। আমার শখের জিনিস। হারায় না যেন।
আমার টর্চ লাগবে না।
অবিশ্যি লাগার কথা না। এখনো আলো আছে। তাহলে টর্চটা বরং থাকুক। হারিয়ে ফেললে গেল। এইসব জিনিস বাংলাদেশে পাওয়া যায় না। বরং এক কাজ করি আমি তোমাকে এগিয়ে দেই।
আমি যেতে পারব।
আচ্ছা যাও। ভয়ের কিছু নাই। আমি এখানে দাঁড়িয়ে থাকব।
ভদ্রলোক রেল লাইনের উপর দাঁড়িয়ে রইলেন।
বাদামের টিন দেখে কুসুম আপুর কোনো ভাবান্তর হল না। বিরক্ত গলায় বলল, তুই নিয়ে যা। বাদাম আমি খাই না।
তোমাকে একটা চিঠিও দিয়েছে।
চিঠি কেন আবার। পড়ে শোনা চিঠিতে কী লেখা।
আমি চিঠি পড়ে শুনালাম।
জাপানি ইঞ্জিনিয়ার সাহেবের চিঠিটায় লেখা—
কুসুম।
Miss Flower,
ম্যাগাজিনগুলো খুঁজে পাচ্ছি না। পাওয়া মাত্র পাঠাব। তোমার সঙ্গে গল্প করে খুবই ভালো লেগেছে। আবারো একদিন গল্প করার জন্যে যাব। তবে কাজের প্রচন্ড ব্যস্ততা।
ইতি
কা. ইসলাম।
কুসুম আপু হাই তুলতে তুলতে বলল, একদিন গল্প করার জন্য আসবে। লিখেছে? সে ইচ্ছা করলেই গল্প করতে পারবে? আমার ইচ্ছা করতে হবে না? কাঃ ইসলাম আবার কী? সরাসরি কাক ইসলাম লিখলেই হত। চেহারা তো কাকের মতোই।
তুমি রাগ করছ কেন?
আমি রাগ করছি না। বিরক্ত হচ্ছি। দেখিস এই লোক খুবই বিরক্ত করবে। মাছি স্বভাবের কিছু মানুষ আছে যাদের প্রধান কাজ অন্যদের বিরক্ত করা। সারাক্ষণ ভ্যানভ্যান করবে। গায়ে বসতে চাইবে। এই ধরণের মানুষ আমার দুই চোখের বিষ।
ও।
লিখেছে না কোনো একদিন গল্প করার জন্য আসবে? তুই দেখিস লোকটা গল্প করার জন্য আজ রাতেই আসবে।
আজ রাতে আসবে না। কাল বিকালে আসতে পারে। চা খাবে আর ম্যাগাজিন দিয়ে যাবে।
দেখিস আজ রাতেই আসবে। যদি আসে আর আমার খোঁজ করে তাহলে বলবি আমার জ্বর। মিথ্যা বলাও হবে না। আমার সত্যিই জ্বর।
ও।
ও কিরে গাধা। কেউ যদি বলে আমার জ্বর তাহলে তার গায়ে হাত দিয়ে দেখতে হয় তার জ্বর কিনা। এটা ভদ্রতা।
আমি গায়ে হাত দিয়ে দেখি কুসুম আপুর সত্যি সত্যি জ্বর। বেশ জ্বর। অথচ সে দিব্যি জ্বর নিয়েই চেয়ারে বসে পা দুলিয়ে দুলিয়ে লিখছে। কুসুম আপুর খুব সুন্দর বাঁধানো একটা খাতা আছে। এই খাতাটা খুব ছোট বেলায় তার বাবা তাকে দিয়েছিলেন। হঠাৎ হঠাৎ কুসুম আপু এই খাতা বের করে কী সব লেখে।
কুসুম আপুর বুকের বিশেষ চিহ্নটা যেমন আমার দেখতে ইচ্ছা করে। খাতাটাও পড়তে ইচ্ছা করে। বুকের চিহ্ন কোনো একদিন দেখলেও হয়তো দেখা যাবে। কিন্তু খাতা কোনোদিন পড়া যাবে না। এটা অসম্ভব ব্যাপার।
শ্রাবণ মাসের নিয়ম হল সারা দিন রোদ থাকবে রাতে শুরু হবে বৃষ্টি। এই বৃষ্টির নাম ঘুম বৃষ্টি। আব্দুর রহমান চাচার ধারণা আল্লাহ্ পাক চোরদের জন্যে
এই ঘুম বৃষ্টির ব্যবস্থা করেন। গৃহস্থ আল্লাহ্ পাককে যত ডাকে, চোররা ডাকে তার চেয়ে বেশি। আল্লাহ্ পাক যেহেতু রহমানুর রহিম, চোরদের কথাও তাঁকে শুনতে হয়। এই জন্যেই ঘুম বৃষ্টির ব্যবস্থা করে দেন। গৃহস্থ আরাম করে ঘুমায়। আর চোর সব সাফা করে দেয়।
শ্রাবণ মাস এখনও শুরু হয় নি। আষাঢ় মাস যাচ্ছে কিন্তু ভাবটা শ্রাবণের। সন্ধ্যার পর থেকে বৃষ্টি। এই বৃষ্টির মধ্যে বাবা ইলিশ মাছ নিয়ে উপস্থিত হলেন। আমাদের অঞ্চলে ইলিশ মাছ পাওয়া যায় না। যারা ময়মনসিংহে যায় তারাই একটা দুটা ইলিশ মাছ সঙ্গে নিয়ে আসে। হঠাৎ হঠাৎ তাদের কারোর কাছ থেকে বাবা মাছ যোগাড় করে ফেলেন। মাছ যোগাড়ের কাহিনী তিনি দীর্ঘদিন বলেন। সেই কাহিনী বলে তিনি বড়ই আনন্দ পান।
বুঝলি টগর চারজন নামল ট্রেন থেকে। একজনেরও টিকেট নাই।। আসছে ময়মনসিংহ থেকে, বলে আঠারোবাড়ি ইস্টিশনে উঠেছি। একটা ইস্টিশন পাড়ি দিছি। এর আবার টিকেট কী? আমি বললাম, ইলিশ মাছ কিন্যা ফিরলা, মাছ পাইলা কই? আঠারোবাড়িতে ইলিশ মাছ পাওয়া যায়? রেলের নিয়ম আছে বিনা টিকেটের যাত্রির ভাড়া ধরা হবে যেখান থেকে ট্রেন যাত্রা শুরু করেছে সেখান থেকে। তাও সিঙ্গেল ভাড়া না, ডাবল ভাড়া। তোমরা বাহাদুরবাদ মেইলে আসছ। বাহাদুরবাদ মেইল যাত্রা করেছে চিটাগাং থেকে। সেইমতো ভাড়া দেও। চাইর জনে দুইশ পঁচিশ টাকা।