আপুকে শাড়িতে খুবই মানিয়েছে। সবুজ শাড়ির সঙ্গে লাল টিপটাতেও মানিয়েছে। আমি তাকে কত ছোট থেকে দেখছি এই আমিই চোখ ফেরাতে পারছি না। জাপানি ইঞ্জিনিয়ার বাইরের মানুষ সে তো মুগ্ধ হবেই। তাছাড়া কুসুম আপুর শরীরে আছে বিশেষ একটা চিহ্ন। এই চিহ্ন থাকলে পুরুষ মানুষ তার আশেপাশে এলেই ফণা নামিয়ে ফেলবে। সাপের মতো সব পুরুষ মানুষেরও ফণা আছে। খুব বিশেষ বিশেষ ক্ষেত্র ছাড়া পুরুষ মানুষ ফণা নামাতে পারে না। (এটা আমার কথা না। কুসুম আপুর কথা।)।
জাপানি ইঞ্জিনিয়ার ভাত খেতে খেতেই ফণা নামিয়ে ফণাবিহীন সাধারণ সাপ হয়ে গেলেন, তার চেহারার মধ্যে গদগদ ভাব চলে এল। মুখের চামড়া হঠাৎ তেলতেলে হয়ে গেল। তিনি হড়বড় করে কুসুম আপুর সঙ্গে অনর্গল কথা বলতে লাগলেন। একটা কথার সঙ্গে অন্য একটা কথার কোনো মিল নেই। তিনি কী বলছেন নিজেও বোধ হয় জানেন না।
কুসুম তুমি কি গল্পের বই পড়। আমি প্রচুর গল্পের বই নিয়ে এসেছি। সময় যখন কাটে না বই পড়ি। অবিশ্যি সবই ইংরেজি থ্রিলার। তুমি ইংরেজি বই পড়তে পার না? অভ্যাস করলেই পারবে। একটা ইংলিশ টু বেঙ্গলি ডিকশনারি নিয়ে বসতে হবে। যে সব শব্দের অর্থ বুঝতে পার না—চট করে ডিকশনারি খুলে দেখে নেবে। এতে একটা ক্ষতি আছে আর একটা লাভ। ক্ষতি হচ্ছে পড়াটা স্লো হয়ে যাবে। আর লাভ হচ্ছে ওয়ার্ড পাওয়ার বাড়বে। কুসুম, ডিকশনারি নিয়ে মজার একটা জোক মনে পড়েছে। খুবই মজার-হা হা হা। জোকটা শোন—পাগলা গারদের এক রোগী। তার খুবই বই পড়ার নেশা। যে বই তাকে দেয়া হয় সেই বইই চট করে পড়ে ফেলে। আরো বই চায়। পাগলা গারদের লাইব্রেরিয়ান তাকে বই দিতে দিতে ক্লান্ত। সব বই সে পড়ে ফেলেছে। অথচ রোগী বই চায়। লাইব্রেরিয়ান তখন করল কি তাকে মোটা ডিকশনারিটা দিয়ে দিল। ও আচ্ছা গল্পটায় সামান্য ভুল করলাম, ডিকশনারি না লাইব্রেরিয়ান তাকে দিয়ে দিল আটশ পৃষ্ঠার টেলিফোন ডিরেক্টরি। টেলিফোন ডিরেক্টরি কি তুমি জানতো? টেলিফোন ডিরেক্টরিতে এলফাবেটিকেলি টেলিফোন গ্রাহকদের নাম লেখা থাকে আর টেলিফোন নাম্বার লেখা থাকে। যাই হোক লাইব্রেরিয়ান টেলিফোন ডিরেক্টরি দিয়ে মহা খুশি। পাগল পরদিনই বলতে পারবে না, বই পড়ে শেষ করে ফেলেছি। ঘটনা হল কি পাগলটা পরদিনই টেলিফোন ডিরেক্টরি ফেরত দিয়ে বলল, স্যার পড়ে ফেলেছি আরেকটা বই দেন। লাইব্রেরিয়ান অবাক হয়ে বলল, বইটা কেমন লাগল? পাগল বলল, উপন্যাসটা খারাপ না, তবে স্যার চরিত্রের সংখ্যা অনেক বেশি। মনে রাখতে গিয়ে কষ্ট হয়েছে। হা হা হা। জোকটা কেমন কুসুম?
কুসুম আপু জবাব দেবে কী সে এমন হাসতে লাগল যে হেঁচকি উঠে গেল। দমবন্ধ হয়ে যাবার মতো হল। জাপানি ইঞ্জিনিয়ার খুবই ব্যস্ত হয়ে গেলেন, পানি খাও তো কুসুম। পানি খাও। তোমাকে তো আর কখনো জোক বলা যাবে না। কী সর্বনাশ। এমন করে কেউ হাসে?
দুপুরে খেয়েই কামরুল সাহেব চলে যাবেন এমন কথা ছিল–তার ভয়ংকর জরুরি কাজ। কিন্তু তিনি সব কাজ ফেলে সন্ধ্যা পর্যন্ত রয়ে গেলেন এবং সন্ধ্যা পর্যন্ত তিনি অনর্গল কথা বললেন। সবই জাপানের গল্প। তিনি জাপানে গিয়ে জাপানের সী ফুড রেস্টুরেন্টে খেতে গিয়েছেন। কোনো খাবার দাবারের নাম জানেন না, শেষে চেহারা দেখে পছন্দ করে একটা খাবার খেলেন। খেতে বেশ ভালো সামান্য টক-টক। তিনি খুবই আগ্রহ করে খেলেন শেষে জানা গেল সেটা ছিল সামুদ্রিক সাপ।
কুসুম আপু চোখ কপালে তুলে বললেন, আপনি সাপ খেলেন?
হ্যাঁ খেলাম। জেনেশুনে তো খাই নি। না জেনে খেয়েছি। তবে পরে অবিশ্যি জেনে শুনে খেয়েছি।
আপনি জেনেশুনে সাপ খেয়েছেন?
হুঁ খেয়েছি। কী করব অন্য কোনো খাবার খেতে পারি না। শেষের দিকে সী ফুড রেস্টুরেন্টে গেলেই সাপের ঝোলের অর্ডার দিতাম।
আমার তো শুনেই বমি এসে যাচ্ছে।
বমি আসার কী আছে। রান্না করা সাপ খাচ্ছি। কাঁচা তো খাচ্ছি না।
কুসুম আপু গাল ফুলিয়ে বলল, আপনি আর সাপ খাবেন না। কোনোদিন না।
ভদ্রলোক আনন্দের হাসি হাসতে হসতে বললেন, আরে তোমাকে নিয়ে তো ভাল ঝামেলা হল। সাপ আর মাছের মধ্যে বেশি কম তো কিছু নেই। বাইন। মাছ খাও না? বাইন মাছ খেতে পারলে সাপ খেতে সমস্যা কী?
কুসুম আপু কাঁদো কাঁদো গলায় বলল, না, সাপ খেতে পারবেন না। আপনি কথা দিন আর সাপ খাবেন না।
উনি হাল ছেড়ে দেয়ার ভঙ্গি করে বললেন, আচ্ছা যাও খাব না।
বলেই তিনি ছোট্ট করে নিঃশ্বাস ফেললেন, যেন সাপ খেতে না পারার দুঃখে তিনি খুবই কাতর হয়েছেন। তার মন পড়ে আছে সাপের ঝোলে।
সন্ধ্যার আগে আগে জাপানি ইঞ্জিনিয়ার তাঁবুর দিকে রওনা হলেন। আমার ধারণা আমরা কেউ যদি একবার বলতাম—রাতের খাওয়া খেয়ে যান, তিনি সঙ্গে সঙ্গে রাজি হয়ে যেতেন। ভদ্রলোক আমাকে সঙ্গে নিয়ে গেলেন। তার কাছে নাকি কিছু ম্যাগাজিন আছে। ম্যাগাজিনগুলো দিয়ে দেবেন। কুসুম আপু পড়বে।।
রেল লাইনের স্লীপারে পা রেখে লাফিয়ে লাফিয়ে তিনি যাচ্ছেন। সাপের শীসের মতো শব্দ করছেন। তাকে দেখেই মনে হচ্ছে তিনি খুবই মজা পাচ্ছেন। যেতে যেতে আমার সঙ্গেও কিছু কথা হল। আমাদের এই অঞ্চলে দেখার মতো কি আছে। এখানে কবে হাট বসে। হাটে কী পাওয়া যায়।
কথা বলার জন্যে কথা বলা।
ভদ্রলোক আমাকে তাঁবুর বাইরে রেখে নিজে তাঁবুতে ঢুকে গেলেন। আমার খুব শখ ছিল তাঁবুর ভেতরটা দেখার। উঁকি ঝুঁকি মেরেও কিছু দেখা যাচ্ছে না। তাঁবুর মুখে পর্দা দেয়া। বেশ ভারী পর্দা। বাতাস হচ্ছে, কিন্তু বাতাসে পর্দা কাঁপছে না। তাঁবুর ভেতর থেকে অষুধ অষুধ গন্ধ আসছে।