মার হাসি কান্না কোনোটাকেই আমরা তেমন গুরুত্ব দেই না। খুব ছোট বেলা থেকেই দেখছি মা কারণ ছাড়াই হাসেন। আবার কারণ ছাড়াই কাঁদেন। তার মানে এই না যে তার মাথার ঠিক নেই। সব মানুষ এক রকম হয় না। একেক মানুষ হয় একেক রকম।
মে মাসের ২৮ তারিখ থেকে এস এস সি পরীক্ষা শুরু হবে। প্রথম দিনে বাংলা। ভাইয়ার পরীক্ষার প্রিপারেশন শেষ। শুধু বাকি ছিল নিন্দালিশের পীর সাহেবের নিজের হাতের লেখা তাবিজ। এই তাবিজও যোগাড় হয়েছে। এই তাবিজের নিয়ম হল যেদিন পরীক্ষা শুরু হবে সেদিন ফজরের নামাজের পর তাবিজটা ডানহাতের কজিতে পরতে হবে। পড়ার সময় তিনবার বলতে হবে— রাব্বি জেদনি এলমান। এর অর্থ হে রব তুমি আমাকে জ্ঞান দাও। যে কদিন তাবিজ বাঁধা থাকবে সে কদিন ফজরের নামাজ কাজা করা যাবে না, মিথ্যা কথা বলা যাবে না, চুল নখ কাটা যাবে না। শেষ পরীক্ষা হয়ে যাবার সঙ্গে সঙ্গে স্রোতস্বিনী নদীতে তাবিজটা ফেলে দিতে হবে। তাবিজ ফেলার পরও সব শেষ না। কিছু কাজ বাকি, মাথা কামিয়ে সেই চুলও ঠিক তাবিজ যেখানে ফেলা হয়েছে সেখানে ফেলে দিতে হবে। মাথার কাটা চুল পানিতে ড়ুবে গেলে উদ্দেশ্য সফল ধরে নিতে হবে। আর চুল যদি পানিতে ভেসে থাকে তাহলে সর্বনাশ।
নিন্দালিশের পীর সাহেব সবাইকে এই তাবিজ দেন না। পীরসাহেবের এক মুরিদের হাতে পায়ে ধরে ভাইয়া তাবিজ জোগাড় করেছে। পরীক্ষা নিয়ে ভাইয়ার মনে সামান্য দুঃশ্চিন্তা ছিল। তাবিজ পাওয়ার পর দুঃশ্চিন্তা দূর হয়েছে।
ভাইয়ার সিট পরেছে আঠারো বাড়ি হাই স্কুলে। ভাইয়ার ধারণা এটাও আল্লাহপাকের খাস রহমত। আঠারো বাড়ির সেন্টার নকলের জন্যে খুবই বিখ্যাত। এই সেন্টারের শিক্ষকরাও নকলের ব্যাপারে সাহায্য করেন। হঠাৎ কোনো ম্যাজিস্ট্রেট চলে এলে শিক্ষকরা ছুটে গিয়ে ছাত্রদের খবর দেন। যে যার বই খাতা যাতে লুকিয়ে ফেলতে পারে।
এমন সুযোগ সুবিধার পরেও কী যে হল—পরীক্ষার ঠিক আগের দিন–২৭শে মে, ভাইয়া আমাকে ডেকে শিমুল গাছের নিচে নিয়ে গেল। গলা নিচু করে বলল, সিদ্ধান্ত নিয়েছি পরীক্ষা দিব না।
আমি কিছু বললাম না। তাকিয়ে রইলাম।
পরীক্ষা দিয়ে লাভ নাই। মাথার ভেতর সব আউলা হয়ে গেছে। ধর পরীক্ষা দিয়ে যদি পাশও করি—তিন ডাণ্ডার পাশ হবে। তিন ডাণ্ডা বুঝিস তো থার্ড ডিভিশন। এদিকে কুসুম পাবে ফার্স্ট ডিভিশন। এক ডাণ্ডা! লজ্জার ব্যাপার।
হুঁ?
এরচে পরীক্ষা না দেয়া ভালো। ঠিক কি না তুই নিজেই বল।
ঠিক।
আমি তো থাকব না। তুই খবরটা সবাইকে দিবি।
তুমি যাচ্ছ কোথায়?
এখনো কিছু জানি না। সাইকেল নিয়ে বের হই। সাইকেলের চাক্কা যে দিক যাবে-আমিও যাব সেই দিকে।
ভাইয়ার সাইকেলের ক্যারিয়ারে কাপড়ের একটা ব্যাগ। হ্যান্ডেলে আরেক ব্যাগ। পানির একটা বোতল। ভাইয়ার মাথায় ক্রিকেট খেলোয়াড়দের টুপির মতো টুপি। তাকে দেখাচ্ছে ভূপর্যটকের মতো। শার্টের পকেট থেকে সানগ্লাস বের হয়ে আছে। আমি বললাম, তুমি ফিরবে কবে?
ভাইয়া উদাস গলায় বলল, কিছুই জানি না। নাও ফিরতে পারি।
আমি তাকিয়ে আছি। ভাইয়া সাইকেল নিয়ে রেল লাইনের পাশের রাস্তায় পায়ে চলা পথে উঠে পড়ল। দৃশ্যটা দেখতে এত ভালো লাগছে। মনে হচ্ছে এই সাইকেল চলতেই থাকবে। কোনোদিন থামবে না। ভাইয়া একবার পেছনে ফিরে হাসল। সেই হাসিটাও এত সুন্দর। সুখী মানুষের হাসি।
মগরা ব্রিজের দুপাশে তাঁবু পড়েছে
মগরা ব্রিজের দুপাশে তাঁবু পড়েছে। শাদা রঙের তাঁবু। রেলের ইঞ্জিনিয়ার এসেছেন, সঙ্গে অনেক লোকজন। মালগাড়িতে করে রোজই কিছু না কিছু আসছে। সবচে বেশি আসছে বালির বস্তা। চটের ব্যাগ ভর্তি বালির বস্তায় ছোটখাট পাহাড়ের মতো হয়ে গেছে। মাটি কাটার একটা ক্রেন এসেছে। হলুদ রঙের এই ক্রেনটা যখন চলে তখন শকুনের বাচ্চার কান্নার মত শব্দ উঠে। ক্রেন যে চালায় সে মোটাসোটা থলথলে ধরণের মানুষ। তার চোখ সব সময় বন্ধ থাকে। মনে হয় সে ঘুমিয়ে ঘুমিয়েই ক্রেন চালায়। তাকে সারাক্ষণ বকা শুনতে হয়। ইঞ্জিনিয়ার সাহেব তাকে বকেন।
এই জমশেদ, এই জম্বু, ঘুমাচ্ছ নাকি? চোখ বন্ধ করে কি করছ? হ্যালো, হ্যালো।
জমশেদ নামের লোকটা চোখ মেলে ফিক করে হেসে আবার চোখ বন্ধ করে ফেলে। ইঞ্জিনিয়ার সাহেব রাগে কাঁপতে থাকেন। গলার রগ ফুলিয়ে চেঁচাতে চেঁচাতে বলেন, তোমার নামে আমি হেড অফিসে রিপাের্ট করব। তুমি চাকরি কী করে কর আমি দেখব। চোখ বন্ধ করে ফাজলামি?
ইঞ্জিনিয়ার সাহেবের নাম—কামরুল ইসলাম। তার বয়স নিশ্চয়ই বেশি। কিন্তু মাঝে মাঝেই তাকে কলেজের ছেলেদের মতো দেখায়। ভদ্রলোকের গায়ের রঙ শ্যামলা। চেহারা খুবই সুন্দর। শাদা রঙ মনে হয় তার খুব পছন্দ। বেশির ভাগ সময় তার পরনে থাকে শাদা প্যান্ট এবং শাদা গেঞ্জি। মাথায় বারান্দাওয়ালা শাদা টুপিও তার ছিল। প্রথম দিনেই বাতাসে সেই টুপি, তার মাথা থেকে উড়ে গিয়ে মগরা নদীতে পড়ল। তিনি অতি ব্যস্ত হয়ে বললেন, টুপিটা রেসকিউ করার ব্যবস্থা কর। কুইক কুইক!
কেউ নড়ল না।
ইঞ্জিনিয়ার সাহেব প্রায় কাঁদো কাঁদো হয়ে বললেন, আমার এটা খুব শখের টুপি। জাপান থেকে কেনা। আমি সাঁতার জানি না। জানলে নিজেই তুলতাম কেউ তুলে দিন বখশিশ পাবেন। ভালো বখশিশ দিব।
বখশিশের ঘোষণাতেও কাজ দিল না। ইঞ্জিনিয়ার সাহেব অসহায়ভাবে টুপির দিকে তাকিয়ে ছটফট করছেন। উপস্থিত দর্শকদের এই দৃশ্য দেখতেই বেশি ভালো লাগছে। টুপি তুলে ফেললে তো আর এমন মজার দৃশ্য দেখা যাবে না। টুপিটা ব্রিজের মাঝখানের স্প্যানের সঙ্গে লেগে ঘুরপাক খাচ্ছে। মনে হচ্ছে। টুপিটাও মজা পাচ্ছে। ড়ুবতে গিয়েও ড়ুবছে না।