নিচে নেমে এসে দেয়ালে পিঠ ঠেকিয়ে নিতু কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে রইল। সে এখানে এসেছে এখনো পুরো একদিন হয় নি, স্কুলটা এখনো ভালো করে চেনা হয় নি। কোন দিক দিয়ে গেলে সবচেয়ে সহজ হবে সে ভালো করে জানে না। তার মাঝেও সে আন্দাজ করে নিয়ে সাবধানে হাঁটতে শুরু করে। স্কুল কম্পাউন্ডের মাঝে মাঝে লাইট জ্বলছে, সে সেগুলি এড়িয়ে অন্ধকারে অন্ধকারে হেঁটে যেতে থাকে। নিশুতি রাত কোথাও কেউ নেই, তার মাঝে একা একা যেতে তার কেমন জানি ভয় করতে থাকে। দিনের বেলা সে ভূত বিশ্বাস করে না, কিন্তু এই রাত্রি বেলা সম্পূর্ণ ভিন্ন ব্যাপার, সে যতগুলি ভূতের গল্প পড়েছিল হঠাৎ করে সবগুলি গল্প তার এক সাথে মনে পড়ে গেল।
নিতু অন্ধকারে নিজেকে আড়াল করে সাবধানে হেঁটে যেতে থাকে। হোস্টেলটা পার হয়ে খানিকটা ফাঁকা জায়গা, তারপর একটা টিউবওয়েল, টিউবওয়েল্টা পার হয়ে এগিয়ে গেলে বেশ কয়েকটা গাছ, তারপর স্কুল বিল্ডিং, তারপর আরো কিছুগাছ সেগুলি পার হয়ে গেলে স্কুলের মাঠ তার অন্যপাশে স্কুলের সীমানার উঁচু দেওয়াল। সেই দেওয়ালের কাছে বড় একটা ঝপড়া গাছে তার ভোটকা মিয়া আটকা পড়ে আছে। নিতু যখন স্কুলের মাঠের কাছাকাছি এসেছে ঠিক তখন সে একটা চাপা গর্জন শুনতে পেল এবং কিছু বোঝার আগেই হঠাৎ করে কী যেন তার উপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। নিতু মাটিতে আছাড় খেয়ে পড়ে ভয়ে আতংকে সে একটা চিৎকার দিয়েই দিচ্ছিল কিন্তু শেষ মুহূর্তে নিজেকে সামলে নেয়, অন্ধকারে ভালো করে দেখা যায় না কিন্তু তার মাঝেও বোঝা যাচ্ছে বিশাল একটা কুকুর তাকে মাটিতে চেপে ধরে রেখেছে, চোখগুলি জ্বলছে আগুনের মতে, ধারালো দাঁত বের হয়ে আছে আর চাপা স্বরে গর্জন করছে, মনে হয় এক্ষুনি বুঝি ধারালো দাঁত দিয়ে ছিঁড়ে ফেলবে তাকে।
কুকুরটা দেখে নিতুর শরীরে প্রাণ ফিরে এল, ফিক করে হেসেও ফেলল সে, চাপা স্বরে বলল, ও মা! একটা কুকুর! কী সুইট। আমি ভেবেছিলাম ভূত!
কুকুরটা তীক্ষ্ণ চোখে নিতুর দিকে তাকিয়ে থাকে, নিতু হাত দিয়ে অবলীলায় কুকুরটাকে উপর থেকে সরিয়ে উঠে বসে সেটার গলা জড়িয়ে ধরে বলল, আয় আমার কাছে আয় পাগল কোথাকার। কী ভয় দেখিয়েছি আমাকে।
একটু আগে যে কুকুরটা একটা ভয়ংকর প্রাণী ছিল হঠাৎ করে নিতুর আদর পেয়ে সেটা কেমন জানি বাচ্চা শিশুর মতো হয়ে উঠে। লেজ নাড়িয়ে দুই পা নিতর শরীরে তুলে তাকে দুই একবার চেটে ফেলল। নিতু খিলখিল করে হেসে ফিস ফিস করে বলল, খবরদার পাজী কুকুর, আমাকে কি লজেন্স পেয়েছিস নাকি? চাটছিস কেন? দেব একটা চড়!
নিতু কুকুরটার গলা ধরে মুখে আদর করে হাত বুলিয়ে দেয় তারপর ফিস ফিস করে বলে, আর আমার সাথে। একা একা যা ভয় পাচ্ছিলাম। এখন আমার আর কোনো ভয় নাই। যদি ভূত আসে তাহলে তুই ধাওয়া করে তাড়িয়ে দিবি। পারবি না?
কুকরটা গররর আওয়াজ করে নিতকে জানিয়ে দিল সে পারবে। তাকে এখন পর্যন্ত কেউ কখনো আদর করে নি। কেউ যদি তাকে আদর করে সে তার জন্যে জীবন দিয়ে দেবে।
কুকুরটাকে পাওয়ার পর নিতুর সাহস একশ গুণ বেড়ে গেল। কিছুক্ষণের মাঝেই অন্ধকারে গুড়ি মেরে সে হেঁটে হেঁটে স্কুল সীমানার কাছাকাছি পৌঁছে গেল। এদিক সেদিক তাকিয়ে সে ঝাপড়া গাছটার নিচে এসে দাঁড়ায়। আবছা অন্ধকারে ওপরে তার ভোটকা মিয়াকে দেখা যাচ্ছে, কী রকম অসহায়ভাবে সে ঝুলে আছে। নিতু ফিস ফিস করে বলল, ভয় নাই ভোটকা মিয়া, আমি এসে গেছি!
ঝাঁপড়া গাছটায় ওঠা খুব সহজ হল না, নিচে কয়েকটা ডাল ছিল বলে রক্ষা, হাঁচড়-পাচড় করে কোনোভাবে নিতু গাছে উঠে গেল, অন্ধকারে ডাল বেয়ে বেয়ে সে ভোটকা মিয়ার কাছে পৌঁছে যায়, ছোট একটা ডালে আটকে ছিল সাবধানে সেখান থেকে ছুটিয়ে নিয়ে এসে বুকে চেপে ধরে ফিসফিস করে বলল, আমার ভোটকা মিয়া! আমি খুব সরি যে তোকে এই রাত্রিবেলা অন্ধকারে গাছের উপর ফেলে রেখেছিলাম। তুই তো নিজেই দেখেছিস রাক্ষসী মহিলা কী ডেঞ্জারাস! তোকে যে লাথি মেরেছিল তুই ব্যথা পাস নি তো? আহারে আমার সোনামণি! আর কেউ তোর গায়ে হাত দিতে পারবে না। আর এখন গিয়ে আমরা ঘুমিয়ে যাই। ঐ দেখ নিচে আমার নূতন বন্ধু! কী সুন্দর দেখেছিস কুকুরটা? একটা নাম দিতে হবে কী নাম দেয়া যায় বল দেখি?
নিতু কখনো মনে মনে কখনো ফিসফিস করে ভোটকা মিয়ার সাথে কথা বলতে বলতে গাছ থেকে নেমে এল, নিচে কুকুরটা তার জন্যে অপেক্ষা করছিল, আবার তার শরীরের উপর সামনের দুই পা তুলে দিয়ে লেজ নাড়তে নাড়তে নিতুকে চেটে দিল। নিতু আবার খিল খিল করে হেসে বলল, আহ্! কী যন্ত্রণা! আমাকে কি ললিপপ পেয়েছিস নাকি যে চেটে দিচ্ছিস? দেব একটা থাবড়া।
কুকুরটা অবিশ্যি থাবড়াকে ভয় পেল না, লেজ নাড়তে নাড়তে নিতুকে ঘিরে ঘুরতে লাগল, কখনো কারো কাছে আদর পায় নি, নিতুর আদর পেয়ে একেবারে গলে গিয়েছে। নিতু কুকুরটার গলা জড়িয়ে বলল, তুই এত চাটাচাটি করিস— তোর নাম হওয়া উচিত ললিপপ। ঠিক আছে? পছন্দ হয়েছে নামটা? ললিপপ?
কুকুরটা দুই পা তুলে কুঁই কুঁই শব্দ করে নূতন নামটা তার কত পছন্দ হয়েছে সেটা জানানোর চেষ্টা করল।
নিতু যখন তার ঘরে ফিরে এসেছে তখন রাত সাড়ে বারটা বাজে। মিতুল ভয় পেয়ে কী করবে বুঝতে না পেরে একে একে সবাইকে ডেকে তুলেছে। সবাই দরজার কাছে দাঁড়িয়েছিল এবং যখন দেখল নিতু তার টেডি বিয়ারটিকে বুকে জড়িয়ে ধরে একেবারে অক্ষত দেহে ফিরে আসছে তারা এত অবাক হল যে