বিকাল বেলা যখল খেলাধূলার নামে তাদের ওপর অত্যাচর করা হচ্ছিল, মাঠের এক মাথা থেকে অন্য মাথায় দৌড়াদৌড়ি করতে হচ্ছিল, খোয়া বাঁধানো পথে লাফাতে হচ্ছিল তখন সে পুরো এলাকাঁটা খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পরীক্ষা করেছে। স্কুলের সামনে সিঁড়ির কাছে যেখানে তার রাক্ষসী খোরাসানী ম্যাডামের সাথে দেখা হয়েছে সেখান থেকে লাথি মেরে তার ভোটকা মিয়াকে ফেলে দেয়া হলে সেটা কোনদিকে যেতে পারে আন্দাজ করে খুঁজে দেখেছে। স্কুলের সীমানার কাছাকাছি একটা বড় ঝাপড়া গাছে ভোটকা মিয়া আটকা পড়ে আছে। খোরাসানী ম্যাডাম অবিশ্যি চেষ্টা করেছিল লাথি মেরে স্কুলের সীমানার বাইরে পাঠিয়ে দিতে কিন্তু ঝাপড়া গাছটা বাঁচিয়েছে। বিকেল বেলা যখন খেলাধূলার নামে তাদেরকে দৌড়িয়ে নেয়া হচ্ছিল নিতু তার মাঝেও চেষ্টা করেছিল কোনোভাবে সরে গিয়ে ভোটকা মিয়াকে উদ্ধার করে আনতে কিন্তু পারে নি। এখন রাত হয়েছে, একটু পরে সবাই ঘুমিয়ে যাবে তখন গিয়ে ভোটকা মিয়াকে উদ্ধার করে আনা যাবে।
নিতু নিঘুম বিছানায় শুয়ে রইল। কান পেতে শুনতে পেল ঝুন ঝুন দুই বোন গলা নামিয়ে ফিসফিস করে কথা বলছে। মিতুলের বিছানা থেকে নিয়মিত নিশ্বাসের শব্দ শোনা যাচ্ছে, মনে হয় এর মাঝেই ঘুমিয়ে পড়েছে। রেবেকার বিছানা থেকে মনে হল খুব চাপা কান্নার শব্দ শোনা যাচ্ছে, মেয়েটা মনে হয় কাঁদছে। এখানে যারা আছে সবার মনের ভিতরেই তো দুঃখ, সারাদিন চেপে চুপে রাখে কাউকে বুঝতে দেয় না। যখন রাত্রে ঘুমাতে আসে তখন মনে হয় নিজের কাছেই সেটা নিজে প্রকাশ হয়ে যায়। নিতু তার মাঝে নিশ্বাস বন্ধ করে শুয়ে রইল।
এভাবে আরো অনেকক্ষণ সময় কেটে গেল। নিতর যখন মনে হল সবাই ঘুমিয়ে গেছে তখন সে খুব সাবধানে বিছানা থেকে নেমে এল। বিছানার নিচে জুতো রাখা ছিল সাবধানে সেগুলি পায়ে লাগিয়ে নেয় তারপর পা টিপে টিপে দরজার দিকে এগুতে থাকে। দরজার ছিটকানিটা বেশ শক্ত করে লাগানো টেনে খুলতে গিয়ে সেটা খুট করে শব্দ করে ফেলল—সাথে সাথে মিতুল ঘুম ভেঙ্গে জেগে উঠে চাপা স্বরে জিজ্ঞেস করল, কে?
আমি। নিতু ফিসফিস করে বলল, আমি নিতু।
ও! বাথরুমে যাবে?
উঁহু।
মিতুল এবারে পুরোপুরি জেগে উঠে বলল, তাহলে?
আমার টেডি বিয়ারটা আনতে যাচ্ছি।
এবারে মিতুল লাফিয়ে বিছানায় উঠে বসল। চাপা গলায় যতটুকু জোরে কথা বলা সম্ভব ততটুকু জোরে বলল, কী বলছ তুমি? তোমার কী মাথা খারাপ হয়ে গেছে?
নিতু আর কথা না বাড়িয়ে দরজা খুলে বের হয়ে গেল। মিতুল পিছনে পিছনে ছুটে এসে চাপা গলায় বলল, দাঁড়াও নিতু! দাঁড়াও! যেও না।
কিন্তু নিতু তার কথা না শুনে বারান্দা দিয়ে ছুটে যেতে থাকে। মিতুল কী করবে বুঝতে না পেরে দরজা ধরে দাঁড়িয়ে রইল। বারান্দায় আলো জ্বলছে বের হলে কেউ না কেউ দেখে ফেলতে পারে তাহলে সর্বনাশ হয়ে যাবে। ভয়ে মিতুলের শরীর কাঁপতে থাকে, নিতু নূতন এসেছে তাই এখনো বুঝতে পারছে না। তাদের হোস্টেলের বড় গেট রাত্রে তালা দেওয়া থাকে বের হওয়ার কোনো উপায় নেই। সেটা একটা বিশাল সৌভাগ্য না হয় মাঝে মাঝেই কোনো না কোনো মেয়ে এখান থেকে পালানোর চেষ্টা করত আর তাহলেই হতো সর্বনাশ। খোরসানী ম্যাডামের ভয়ংকর—কুকুর সিংঘিকে রাতের বেলা ছেড়ে দেওয়া হয়। স্কুল কম্পাউন্ডের ভিতর কেউ এলে তাকে একেবারে টুকরা টুকরা করে ছিঁড়ে ফেলবে। এই স্কুলের মাঝে কে বেশি ভয়ংকর খোরাসানী ম্যাডাম না কি তার কুকুর সিংঘি সেটা নিয়ে মাঝে মাঝে তর্ক বিতর্ক হয়। দিনের বেলা সিংঘিকে শিকল দিয়ে বেঁধে রাখা হয়। বিশাল কুকুরটী তখন ধারালো দাঁত বের করে স্কুলের মেয়েদের দিকে তাকিয়ে থাকে, কেউ কাছাকাছি এলে মেঘের গর্জনের মতো শব্দ করে শেকল ছিঁড়ে লাফিয়ে পড়ার চেষ্টা করে। কোনোভাবে যদি শেকল ছিঁড়ে বের হয়ে আসে তখন কী হবে সেটা চিন্তা করে মিতুলের মতো অনেকেরই হাত-পা ঠান্ডা হয়ে আসে।
মিতুল নিশ্বাস বন্ধ করে দাঁড়িয়ে রইল, নিতু নামের এই নূতন পাগলাটে মেয়েটা গেট বন্ধ দেখে এখন নিশ্চয়ই ফিরে আসবে, কিন্তু সে ফিরে এল না আর তাই দেখে মিতুলের মনে হল সে ভয়ে, আতংকে আর দুশ্চিন্তায় বুঝি হাঁটু ভেঙ্গে পড়ে যাবে! কী হয়েছে মেয়েটার? কোথায় গিয়েছে?
নিতু ঘর থেকে বের হয়ে বারান্দা ধরে গিয়ে সিঁড়ি দিয়ে সাবধানে এক তলায় নেমে এল। চারিদিকে আলো জ্বলছে কেউ দেখে ফেললে সর্বনাশ হয়ে যাবে। গেটের সামনে এসে নিতু অবাক হয়ে আবিষ্কার করল সেখানে এত বড় একটা তালা ঝুলছে, বের হবার কোনো উপায় নেই। এতগুলি মেয়েকে তালা মেরে আটকে রাখা হয় ব্যাপারটা নিজের চোখে দেখেও তার বিশ্বাস হয় না। গেটের সামনে দাঁড়িয়ে কী করবে সেটা নিয়ে খানিকক্ষণ চিন্তা করে সে আবার খুব সাবধানে নিঃশব্দে উপরে উঠে এল। বারান্দার রেলিং টপকে সে খুব সাবধানে কার্নিশে নেমে এল। কার্নিশ ধরে সে শুড়ি মেরে হেঁটে যেতে থকে বাথরুমের কাছাকাছি পানির পাইপ নিচে নেমে গেছে, সে সেই পাইপ বেয়ে নেমে যাবে। আধো আলো আধো অন্ধকারে গুড়ি মেরে কার্নিশের ওপর দিয়ে হেঁটে হেঁটে শেষ পর্যন্ত বাথরুমের কাছে পৌঁছাল, যে রকম ভেবেছিল ঠিক সে রকম সত্যি সত্যি কয়টা পানির পাইপ নিচে নেমে গেছে। নিতু সাবধানে একটা পাইপ ধরে পিছলে পিছলে নিচে নেমে এল। পাইপ বেয়ে নামা খুব সহজ, কিন্তু কীভাবে উঠে আসবে কে জানে? এখন অবিশ্যি সেটা চিন্তা করে লাভ নেই।